ভেলোরে এক নাগাড়ে ছ’মাস ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধে হার মানেনি সে। দাঁতে দাঁত চেপে কেমোথেরাপির যন্ত্রণা সহ্য করেও লড়াইয়ের ময়দান থেকে ছিটকে যায়নি ১৬ বছরের কিশোর।
আইসিএসই-তে এ বার ৮৭ শতাংশ নম্বর পেয়েছে শুভঙ্কর ভগত। আসানসোলের সেন্ট প্যাট্রিক স্কুলের ফুটবল টিমেও নিজের পাকা জায়গা পুনরুদ্ধার করেই ছেড়েছে। স্কুলের ডেপুটি হেডবয়ও এই ছেলেটি। যুবরাজ সিংহের জাতীয় দলে প্রত্যাবর্তনের ঠিক আগেই শুভঙ্করের হার না-মানা জেদকেও কুর্নিশ করল কলকাতা।
শনিবার ‘দ্য টেলিগ্রাফ এডুকেশন ফাউন্ডেশন’ আয়োজিত উৎকর্ষ-পুরস্কারের ১৭তম আসর বসেছিল সায়েন্স সিটি-র প্রেক্ষাগৃহে। স্কুল-ক্লাসঘরের চৌহদ্দি ছাপিয়ে শিক্ষার বিস্তৃত ক্ষেত্রকে স্বীকৃতিই অনুষ্ঠানের মূল সুরটি বেঁধে দিল।
‘দ্য টেলিগ্রাফ স্কুল অ্যাওয়ার্ডস’-এর ‘হল অফ ফেমে’ এ বার তাই ঢুকে পড়েছেন এক দরদী ফুটবল-শিক্ষক। সুশীল ভট্টাচার্য। ঋজুদেহী পক্ককেশ ‘তরুণ’কে গটগটিয়ে মঞ্চে উঠতে দেখলে কে বলবে, আর দু’বছর বাদেই নব্বইয়ের কোঠায় ঢুকে পড়বেন তিনি! তাঁকে ঘিরে দাঁড়ানো ‘শিষ্য’রাও অনেকেই এখন পক্ককেশ। ‘অর্জুন’ শান্তি মল্লিক, সুকুমার সমাজপতি, সুরজিৎ সেনগুপ্ত, ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়, কুন্তলা ঘোষদস্তিদারের মতো দিকপাল ফুটবলাররা অনেক দিন বাদে ‘স্যার’কে দেখে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। ময়দানের এই বিস্মৃতপ্রায় ‘দ্রোণাচার্য’-কে কুর্নিশের মুহূর্তে আবহে বেজেছে ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’। |
শুধু রাতদিন ঘাড় গুঁজে বই মুখস্থ করে পড়াশোনা নয়। ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের ফর্মুলায় একটা সময়ে খেলাধুলোও জরুরি উপকরণ বলে মনে করত বাঙালি। সুশীল ভট্টাচার্যেরা সেই যুগের মানুষ। ’৪০-এর দশকে ইস্টবেঙ্গলের কৃতী খেলোয়াড়, ময়দানের ‘সুশীলদা’ পরে কোচ হিসেবেও বাংলার ফুটবলে সর্বস্তরে তালিম দিয়েছেন।
পুরস্কারজয়ীদের মধ্যে অনেকেই খেলার মাঠের নায়ক। না, বুকে-মাথায় স্পনসরের ‘লোগো’-খচিত তারকাদের বীর-পুজো নয়। মাঠে-ময়দানে কাব্যে উপেক্ষিতদের লড়াইকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন উদ্যোক্তারা। শাসনের রাইট হাফ আমিরুল মণ্ডল, বারাসতের কাছে শিউলি গ্রামের দৌড়বীর সাথী নেয়ে, শানু ভৌমিক লড়াইয়ের পথটা এদের কারওরই মসৃণ নয়। সাথীর বাবা মাছ বিক্রি করেন, শানুর বাবা গ্রামে মাটি কোপান, আমিরুলের বাবারও ছোটখাটো চাকরিই ভরসা। তিন ‘কৃতী’ই স্কুলে যাচ্ছে। কিন্তু দারিদ্রের চোখরাঙানিতেও খেলাধুলোর যুদ্ধজয়ের স্বপ্নটা তারা হারিয়ে ফেলেনি।
লড়াকুদের পুরস্কার দিতে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরাও সাহস ও মনের জোরের মূর্তিমান প্রতীক। কন্যাকুমারিকা থেকে এসেছিলেন দুই মৎস্যজীবী এডওয়ার্ড শেখর ও গুণশেখর। ২০০৪-এ সুনামির সময় উত্তাল সমুদ্রে ডিঙি নৌকো ভাসিয়ে ‘বিবেকানন্দ রকে’ আটকে-পড়া দর্শনার্থীদের বাঁচান ওঁরা। এসেছিলেন নাগপুরের জগদীশ খারে ও তাঁর স্ত্রী। স্থানীয় একটি পুকুরে ‘ডুবন্ত’ মানুষদের অনেককে বাঁচিয়েছেন। বিপর্যয়ের সময়ে নাগপুর পুরসভার ডুবুরি হয়ে উঠেছিলেন ওঁরাই।
বাঁকুড়ার ঝড়ুপ্রসাদ দত্ত ও আলিপুরদুয়ারের দ্বীপচরের শ্যামা রায়ও এ দিনই প্রথম কলকাতায় এলেন। শুশুনিয়ার পাদদেশে চা-বিক্রেতা ঝড়ুপ্রসাদই ট্রেকিং-প্রিয় তরুণ-তরুণীদের অলিখিত পথপ্রদর্শক। যে কোনও বিপদে ঝড়ু পাশে আছেন। আর উত্তাল কালজানি নদীতে নিজের শাড়ির প্রান্ত ছুড়ে বিপন্ন এক বালক ও তার বাবাকে বাঁচান শ্যামা। স্বামী প্রেমানন্দ ও ছোট মেয়ে অমৃতার সঙ্গে বাংলার এই ‘বীর-বধূ’কে দেখে উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারেনি কলকাতা। |