ঘুরে দাঁড়াতে ব্যবসার খোলনলচে আমূল পাল্টে ফেলতে চাইছে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ইনফোসিস।
গত এক বছর ধরেই প্রত্যাশার তুলনায় খারাপ ফল করছে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের এই ‘শো-কেস’ সংস্থা। নিজেদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থতা, বাজারে দখল কমা, কর্মীদের বেতন বৃদ্ধি বন্ধ রাখা এবং সংস্থার শেয়ার দর প্রায় ১২% পড়ে যাওয়ার মতো সমস্যা তাড়া করেছে ৩০ বছর পূর্ণ করা ইনফোসিস-কে। কিন্তু এর পরও ৭০০ কোটি ডলার (৩৮,৫০০ কোটি টাকা) ব্যবসা করা সংস্থার বেহাল দশা নিয়ে মুখ খোলেননি কোনও কর্তা।
তবে এ বার এই প্রথম ব্যবসা নিয়ে সংস্থার মুখ না-খোলার ঐতিহ্য ভেঙে সর্বসমক্ষে ইনফোসিস-এর পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন চিফ এগ্জিকিউটিভ অফিসার এস ডি শিবুলাল। জানিয়েছেন, শুধুমাত্র বিদেশি সংস্থার হয়ে পরিষেবামূলক (কাস্টমার কেয়ার) আউটসোর্সিং-এর কাজে নিজেদের আটকে রাখতে চান না তাঁরা। বরং এখন থেকে ব্যাঙ্ক অফ আমেরিকা, মেরিল লিঞ্চ-এর মতো বহুজাতিকের জন্য বিশেষ সফটওয়্যার তৈরি এবং তা পরিচালনার দিকেই বেশি করে ঝুঁকবে ইনফোসিস। এই পরিকল্পনাকে ‘ইনফোসিস ৩.০’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, আগামী পাঁচ-ছয় বছরে সফটওয়্যার ব্যবসা থেকে নিজেদের এক তৃতীয়াংশ আয় করাই আপাতত তাঁদের লক্ষ্য। বর্তমানে যা মাত্র কয়েক শতাংশ। এই পরিকল্পনা কার্যকর করাও শুরু করেছে সংস্থা। তবে তাঁর দাবি, পরিকল্পনা কার্যকরী হয়ে প্রত্যাশিত ফল দিতে এখনও কিছুটা সময় নেবে।
তবে ইনফোসিস একাই এই পথে হাঁটছে না। মন্দার কারণে আমেরিকা ও ইউরোপের প্রায় সমস্ত সংস্থাই সাধারণ আউটসোর্সিং-এর কাজে কাটছাঁট করেছে অনেকটাই। বরং এখন কম খরচে উন্নত প্রযুক্তিগত পরিষেবা পেতে আগ্রহী তারা। যে কারণে চটজলদি বরাত না-দিয়ে তা করার আগে বহু বার ভাবছে পশ্চিমী সংস্থাগুলি। |
তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির সংগঠন ন্যাসকম জানিয়েছে, এই অবস্থায় ব্যবসার কৌশল পরিবর্তনের পথে হাঁটতে শুরু করেছে এ দেশের একাধিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা। সাধারণ আউটসোর্সিং-এর বদলে বিজনেস প্রসেস ম্যানেজমেন্টের দিকে ঝুঁকছে তারা। লক্ষ্য, তার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়ানো। সে দিক থেকে দেখতে গেলে, ইনফোসিস-ও এই চিন্তাধারার ব্যতিক্রম নয়। কৌশল ঠিক মতো কাজ করলে, এক দিকে যেমন তারা নির্দিষ্ট বাজার ধরার পথে হাঁটতে পারবে, তেমনই আরও বেশি করে অর্জন করবে বিদেশি সংস্থার আস্থাও। ফলে ভবিষ্যতে গ্রাহক নিয়ে আর ভাবতে হবে না তাদের।
যদিও সংস্থার নতুন ব্যবসায়িক কৌশল এবং সাম্প্রতিক অবস্থায় অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে কর্মীদের মনে। অনেক পুরনো কর্মীই ইনফোসিস ছেড়ে চলে গিয়েছেন। সংস্থা বদলের বিচারে ২০১২-এর জুন পর্যন্ত টিসিএসের ১০.৯ শতাংশের তুলনায় অনেকটাই বেশি ইনফোসিসের ১৪.৯%। তার উপর চলতি বছরে বেতন বাড়েনি। ফলে ভবিষ্যতেও পছন্দের সংস্থা হিসেবে ইনফোসিস কতটা এগিয়ে থাকবে, তা নিয়ে সন্দিহান অনেকে।
এই পরিস্থিতিতে শিবুলালের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কর্মী নিয়োগের বিচারে এখনও অনেকটাই এগিয়ে তাঁরা। কর্মীদের বেতন বৃদ্ধি সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তা একেবারে বাতিল করা হয়নি। আর তাঁর মতে, দীর্ঘ মেয়াদে মাঝে মধ্যে নিয়োগ সাময়িক ভাবে বন্ধ থাকা স্বাভাবিক। কারণ, তা না-হলে, এক সময় কাজের তুলনায় কর্মী সংখ্যা বেশি হয়ে যাবে। তাই আপাতত সংস্থার মানব সম্পদের দক্ষতাকে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবহার করাই মূল লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন তিনি। তাঁর দাবি, পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করতে পারলে সংস্থার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত। তবে সে জন্য প্রয়োজন যত বেশি সম্ভব দরপত্র জেতা।
অবশ্য সংস্থার তরফে এই আশ্বাস সত্ত্বেও লগ্নিকারীদের চিন্তায় রেখেছে ইনফোসিসের ঝুঁকি এড়িয়ে চলার প্রবণতা। সিইও বেছে নেওয়া থেকে শুরু করে নিজেদের পণ্যের দাম নির্ধারণপ্রায় সব ক্ষেত্রেই এই প্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। সঠিক সময়ে কৌশল বদলাতে না-পারায় গত এক বছরে বিশ্বের ৭১টি বড় ও মাঝারি নথিভুক্ত তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার মধ্যে শেয়ার দর খোয়ানোয় চতুর্থ স্থানে রয়েছে ইনফোসিস। ফলে, আগামী দিনে সংস্থা কী ভাবে নিজেদের পরিকল্পনা সাজাবে, তার উপরই নির্ভর করছে তাদের ব্যবসায়িক সাফল্য। |