|
|
|
|
ফড়ে-দৌরাত্ম্যে অসহায় চাষিরা |
নিলয় দাস • ধূপগুড়ি |
মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বেগুন ফলিয়েছেন ধূপগুড়ির বামনটাঁড়ি গ্রামের নীলকমল সরকার। ভাদ্রের গোড়ায় সেই বেগুনের দাম বাজারে ভালই মিলবে এমন আশায় বুক বেঁধেছিলেন তিনি। সাতসকালে বাজারে সবজি বোঝাই ভ্যান পৌঁছনোর পরে তাঁকে ঘিরে ফেলল ‘ফড়েরা’। দরাদরি করে শেষ পর্যন্ত ৫ টাকা কেজি দরে ভ্যান বোঝাই বেগুন বিক্রি করতে হল তাঁকে। টাকা গুনে বাড়ির পথে রওনা হলেন নীলকমলবাবু। ফেরার পথে এক আত্মীয়ের বাড়ি হয়ে দুপুরে টুকটাক কেনাকাটা করতে ধূপগুড়ি সবজি বাজারে ঢুকে চমকে উঠলেন নীলকমলবাবু। দেখলেন, বাজারে বেগুন বিক্রি হচ্ছে ১৬ টাকা কেজি। সকালে যেখানে নীলকমলবাবু বেগুন ফড়েদের কাছে বিক্রি করেছেন, সেখান থেকে ধূপগুড়ির সবজি বাজারের দূরত্ব ১৩ কিমি।
১৩ কিমি পথ পাড়ি দিতেই ১১ টাকা দর বেড়ে গেল? নীলকমলবাবু মাত্র ৫ টাকা কেজি বিক্রি করতে বাধ্য হলেন কেন? ওই এলাকার বাকি বেগুন চাষিদের অবস্থাই বা কী?
সবজি ব্যবসায়ীদের তরফে কয়েক জনের হিসেব অনুযায়ী, ধূপগুড়ি বাজারে অলিখিত ভাবে ২০০-র বেশি ফড়ে রয়েছেন। এত সংখ্যক ফড়ে থাকার অন্যতম কারণ হল, উত্তরবঙ্গে ধূপগুড়িতেই শাক-সবজি, আলুর ফলন বেশি হয়। প্রচুর সবজি নিয়মিত ভাবে উত্তরবঙ্গের নানা জেলায় তো বটেই, অসম,সিকিম ভুটানের বাজারে যায়। বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা পাইকাররা ট্রাক বোঝাই সবজি ওই বাজার থেকে কেনেন ফড়েদের মাধ্যমে। যে হেতু প্রচুর পরিমাণ সবজি কিনতে হয় বাইরের ব্যবসায়ীদের, সে জন্য তাঁরা চাষিদের থেকে ৪০-৫০ কেজি করে কিনতে চান না। বরং ফড়েরা চাষিদের থেকে কিনে সেই সবজি বাজারে রেখে বাইরের পাইকারদের ডেকে দরাদরি করে তা বিক্রি করেন। পাইকাররা তা নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছনোর পরে সেখানকার খুচরো বিক্রেতাদের কাছে তা বিক্রি করেন। এভাবে কয়েক হাত ঘোরার ফলেই সবজির দাম ৪ থেকে ৫ গুণ বেড়ে যায় বলে ব্যবসায়ীরাই জানিয়েছেন।
ধূপগুড়িতে পাইকারদের ‘এজেন্ট’ হিসেবে কাজ করেন রতন সাহা, আবু তাহেরের মতো অনেকেই। তাঁদের কয়েকজনের যুক্তি, “আমরা কেজি প্রতি বেগুন বা অন্য ফসলে ১ থেকে ২ টাকা লাভ করি। কৃষকদের থেকে বাছাই করে সবজি কিনি না। পাইকাররা তা বেছে নেয় সে সময় বেশ কিছু সবজি ফেলে দিতে হয়। বাজারের সবজির চড়া দামের পেছনে আমাদের হাত নেই।” কোচবিহার থেকে ধূপগুড়ি নিয়ন্ত্রিত নাজারে সবজি কিনতে আসা পাইকার অমর পালের কথায়,“আমাদের পক্ষে ব্যাপক পরিমাণ নানা সবজি কৃষকদের থেকে কেনা সম্ভব নয়। কদিন আগেই ৮ টাকা কেজি দরে ফড়েদের কাছ থেকে বেগুন কিনেছি। কোচবিহারে ১০-১২ টাকায় বিক্রি করতে হবে। গন্তব্যে পৌঁছতে মাল নষ্ট হয়। ট্রাকভাড়া, শ্রমিক খরচ রয়েছে।”
এ বার একনজরে দেখা যাক, ডাউকিমারি গ্রাম থেকে ৩ কিমি দূরের বামনটারির বেগুন চাষিদের ঠিক কী অবস্থা?
গ্রামে অন্তত ৫০০ জন চাষি। উঁচু জমি। তাই বর্ষাকালে বেগুন চাষ করলে লাভ হবে, এই আশায় গ্রামের চাষিরা বেগুন ফলিয়েছেন। বিঘা প্রতি বেগুন চাষে এবার খরচ পড়েছে ১৮ হাজার টাকা। গত বার সারের দাম ছিল অর্ধেক। তাই প্রায় অর্ধেক খরচে সে বার এ সময়ে বেগুন ফলিয়ে ১৪-১৬ টাকা কেজি প্রতি দাম মিলেছিল। লাভের মূখ দেখেছিলেন কৃষকরা। এবার অবশ্য চিত্রটা অন্য রকম। টানা আড়াই মাস বেগুন গাছের পরিচর্চা করে গাছে ফল আসার পরে প্রথম দু সপ্তাহ ২০ থেকে ২৫ টাকা কিলো দরে বেগুন বিক্রি করতে পেরেছিলেন তারা। সপ্তাহ খানেক ১০ -১২ টাকা দরে বেগুন বিক্রি হয়। গত এক মাস ধরে সে দাম তলানিতে ঠেকে। গত দু’ সপ্তাহ ধরে ৫ থেকে সাড়ে ৫ টাকা প্রতি কেজি দরে ফড়েরা বেগুন কিনেছে। সাতসকালে বাজারে সেই বেগুন ৬ থেকে ৭ টাকার মধ্যে দাম ঘোরাফেরা করে। বেলা বাড়তেই বাজারে সাড়ে ৪ টাকা দরে বেগুন বিক্রি হয়। বামনটারির সত্য সরকার, হরিপদ সরকারের অভিযোগ, ধূপগুড়ির বাজারে ঝিঙে ৪ টাকা, পটল ১০ টাকা, কাকরোল ৬ টাকা কেজি দরে চাষিদের থেকে কিনছে ফড়েরা। অথচ তা ধূপগুড়ি বা ফালাকাটা বাজারে তিন গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। সংলগ্ন কোচবিহার জেলার শিঙ্গিজানি গ্রামের বিমল সরকার এক বিঘা জমিতে কারকোল চাষ করে থাকেন। তাঁর কথায়,“খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা। এখন মাত্র ৮ হাজার টাকা পেয়েছি কারকোল বিক্রি করে। কয়েকদিন পর গাছ থেকে ফল মিলবে না।”
চাষিদের প্রশ্ন, কৃষি বিপণন দফতর করছেটা কী?
জলপাইগুড়ি জেলা কৃষি বিপণন আধিকারিক সুব্রত দে নিজেদের পরিকাঠামো না-থাকার জন্যই কিছু করতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, “ফড়ে নিয়ন্ত্রণ করার মত আমাদের তেমন পরিকাঠামো সে অর্থে নেই। তবে নানা স্তরে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার জন্য আলোচনা করছি আমরা।” তিনি জানান, ধূপগুড়ি নিয়ন্ত্রিত বাজারে স্বল্প সময়ের জন্য তরিতরকারি মজুত রাখার জন্য একটি হিমঘর তৈরি হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী যোগান থাকলে যখন সবজির দাম পড়ে যায়। সে সময় কৃষকরা চাইলে হিমঘরে ফসল রাখতে পারবেন বলে তাঁর আশা। ধূপগুড়ির কৃষি আধিকারিক দেবাশিস সর্দারের কথায়, “কৃষকের পরে তিন- চার জনের হাত ঘুরে বাজারে সবজি আসে। এই সমস্যা দীর্ঘদিনের। কী ভাবে মেটানো যায় তা কৃষি বিপণন দফতরকেই দেখতে হবে।”
কৃষি দফতর ও কৃষি বিপণন দফতরের মধ্যে সমন্বয় নেই বলেই তাঁদের সমস্যা মেটে না বলে অভিযোগ করেছেন চাষিরা। ধূপগুড়ির চাষিরা গোটা বিষয়টি উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবকে জানাবেন বলে জানিয়েছেন। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী বলেন, “আমি বিশদে খোঁজখবর নেব। মুখ্যমন্ত্রীকেও জানাব।” ফালাকাটার তৃণমূল বিধায়ক অনিল অধিকারী বলেন, “চাষিরা যাতে লাভজনক দাম পান তা দেখতে সরকারি পর্যায়ে নজরদারি শুরু হয়েছে।”
|
|
|
|
|
|