বাগনানের পানিত্রাস, সামতা এবং গোবিন্দপুর এই তিনটি গ্রামের সংযোগস্থলে বাড়ি তৈরি করেছিলেন কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনটি গ্রামের সংযোগস্থল হওয়ায় এলাকার নাম তিনি দিয়েছিলেন সামতাবেড়। তাঁর তৈরি বাড়ি এখনও অবিকল আছে। একই সঙ্গে যেন কথাশিল্পীর যুগেই পড়ে রয়েছে এলাকার স্বাস্থ্য পরিষেবা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার হাল।
তিনটি গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলির অভিযোগ, এখানে কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। ফলে অসুখ-বিসুখ হলে যেতে হয় অন্তত ১০ কিলোমিটার দূরে বাগনান গ্রামীণ হাসপাতালে। এ দিকে, রাস্তার হাল শোচনীয়। দেউলটি থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার পার হয়ে আসতে হয় পানিত্রাসে। পাকা এই রাস্তায় তৈরি হয়েছে ঘন ঘন গর্ত। এই রাস্তা দিয়ে রোগীদের বাগনান গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যেতে তাঁদের সমস্যায় পড়তে হয় বলে বাসিন্দারা জানালেন।
শরৎচন্দ্রের বাড়ি দেখতে রবিবার এবং অন্যান্য ছুটির দিনে বহু পর্যটক আসেন। এই রাস্তার উপর দিয়ে গাড়ি নিয়ে যাতায়াত করতে তাঁদের নাকাল হতে হয়। বর্ষাকালে রাস্তার অবস্থা একেবারেই বেহাল হয়ে পড়ে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, তাঁরা বহু বার রাস্তা মেরামতির জন্য পূর্ত (সড়ক) দফতরের কাছে দাবি করেছেন। কিন্তু রাস্তার হাল ফেরাতে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পূর্ত (সড়ক) দফতরের হাওড়া ডিভিশন সূত্রের অবশ্য দাবি, সম্প্রতি রাস্তার গর্ত বোজানো হয়েছে। বাসিন্দারা পাল্টা অভিযোগ করেছেন এ ভাবে গর্ত বোজালে হবে না। পাকাপাকি ভাবে রাস্তার মেরামতির কাজ করতে হবে। |
বেহাল স্বাস্থ্য পরিষেবাও। গোবিন্দপুর গ্রামটি তফসিলি সম্প্রদায় অধ্যুষিত। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বছর দুই আগে ‘আশ্রয়’ প্রকল্পে এই গ্রামের ৬২ জন ধীবর সম্প্রদায়ের মানুষকে পাকা বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। কথাশিল্পীর নামে এই আবাসনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘শরৎ কলোনি’। কিন্তু আবাসনের বাসিন্দা দরিদ্র এই সব মানুষদের অভিযোগ, এলাকায় কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র না-থাকায় তাঁরা নূন্যতম স্বাস্থ্য পরিষেবা পান না। বিশেষ করে প্রসূতিদের সমস্যা হয়। এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা পার্বতী ধাড়া বললেন, “শরৎচন্দ্র আমাদের এলাকার গরিব মানুষদের বিনা পয়সায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন। তাঁর মৃত্যুর পরে কেটে গিয়েছে এত বছর। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল ফিরল না।” তিনি আরও বলেন, “এখানে কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। বাগনান গ্রামীণ হাসপাতালে প্রসূতিদের নিয়ে যাওয়ার মতো প্রয়োজনীয় রাস্তা খরচও আমাদের মধ্যে অনেকের থাকে না। তার উপরে রাস্তার যা হাল। ঝাঁকুনিতে অ্যাম্বুলান্সেই অনেকের প্রসব হয়ে যায়। ফলে বাড়িতেই প্রসব করাতে হয় অনেকের। সে ক্ষেত্রে ‘ধাইমা’ই ভরসা। বাড়িতে প্রসব হওয়ার ফলে অনেক প্রসূতির শারীরিক সমস্যা হয়।” এই এলাকার গরিব মানুষের চালচিত্র উঠে এসেছে কথাশিল্পীর বহু গল্প উপন্যাসে। সেই পটভূমি এখনও বিরল নয় তাঁর বাসস্থান সংলগ্ন গ্রামগুলির দরিদ্র মহল্লাগুলিতে।
জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা অবশ্য জানিয়েছেন, শরৎ গ্রাম পঞ্চায়েতে সদর উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। এক সময়ে ভাবা হয়েছিল, এখানেই প্রসবের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু পরবর্তীকালে সরকার জানায়, এখানে প্রসব হবে না। তার বদলে গ্রামীণ হাসপাতালে টোল ফ্রি নম্বরে ফোন করলে প্রসূতিদের নিয়ে যেতে অ্যাম্বুলান্স চলে আসবে। বাগনান গ্রামীণ হাসপাতালের সুপার ইন্দ্রনীল মিত্র বলেন, “আমাদের হাসপাতালে সব সময় অ্যাম্বুলান্স থাকে। ফোন করলেই যে কোনও মানুষ প্রয়োজনে এই পরিষেবা পেতে পারেন।”
শরৎচন্দ্রের বাসস্থানকে কেন্দ্র করে তিনটি গ্রামের সার্বিক উন্নতির দাবিতে গ্রামবাসীরা গণসাক্ষর সংগ্রহ করছেন বলে জানিয়েছেন শরৎস্মৃতি গ্রন্থাগারের সম্পাদক ভাস্কর রায়। তিনি বলেন, “রাস্তাঘাটের উন্নতি, এলাকায় ১০ শয্যা বিশিষ্ট উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বাস চলাচলের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি দাবিতে আমরা সই সংগ্রহ করছি। তা বিভিন্ন মহলে পাঠানো হবে।” |