বটানিকাল গার্ডেন-এর সবুজ রক্ষায় কলিকাতা হাইকোর্ট কিছু জরুরি নির্দেশ দিয়াছে। ঐতিহ্যশালী এই উদ্যান উত্তরোত্তর ধ্বংসের পথে যাইতেছিল। পরিবেশবিদদের লড়াই এবং আদালতের সময়োচিত হস্তক্ষেপই সেই অধোগমনকে ঠেকাইতে উদ্যোগী হইয়াছে। কর্তৃপক্ষের তরফে উদ্যানের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার কোনও উদ্যোগ ছিল না, প্রাতর্ভ্রমণকারীদের তরফেও নহে। বিপরীতে ছিল চরম ঔদাসীন্য এবং উদ্যানকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করিবার বিপথগামিতা। উদ্যানের বিস্তৃত প্রাঙ্গণ বিবাহ, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া দেওয়া হইত, আর ভোজনরসিকদের ফেলিয়া যাওয়া পলিথিনের জঞ্জাল উদ্যানের সর্বত্র উড়িয়া বেড়াইত। পরিবেশবিদরা এবং আদালত এই দুর্গতি হইতে শিবপুরের বাগানটিকে রক্ষা করিতে সচেষ্ট হইয়াছেন।
উদ্যান-সফরকারীরা খাবারদাবার লইয়া চড়ুইভাতি করার যে প্রথা চালু করিয়াছিলেন, আদালত তাহা বন্ধ করার নির্দেশ দিয়াছে। অতঃপর খাবারের প্যাকেট, ঠোঙা, পলিথিন-প্যাক লইয়া উদ্যানে প্রবেশ নিষিদ্ধ। উদ্যানের সৌন্দর্য এবং স্বাস্থ্য নষ্ট করিতে এই সব প্যাকেট বা ঠোঙার ভূমিকা প্রচুর। আদালত উদ্যানের ভিতর বন্ধ কাফেটেরিয়াটি পুনরায় চালু করার অনুমতি দিয়াছে। ২০১০ সালে এই কাফেটেরিয়াই কিন্তু উদ্যানপ্রাঙ্গণে বিয়েবাড়ির ভোজসভার আয়োজন করিয়া লাইসেন্স হারাইয়াছিল। নূতন করিয়া কাফেটেরিয়া চালু হইলে সেই অনাচারের যে পুনরাবৃত্তি হইবে না, তাহার নিশ্চয়তা কী? উদ্যানরক্ষার স্বার্থেই আদালতের ডিভিশন বেঞ্চ এই সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করিয়া দেখিতে পারে। ক্ষুধার্ত বোধ করিলে দর্শনার্থীরা উদ্যান-চত্বরের বাহিরে আসিয়াই তো ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করিতে পারেন। প্রধান ফটকের বাহিরেই সে জন্য রেস্তোরাঁ গড়িয়া দেওয়া যায়। এক বার কাফেটেরিয়া চালু করিলে প্রথম-প্রথম হয়তো কড়া নজরদারির মধ্যে নিয়ম মানিয়া ঠিকঠাক সব চলিবে। কিন্তু কিছু দিন যাইতে-না-যাইতে প্লাস্টিক-পলিথিনের প্লেট ও গ্লাসের জঞ্জালে উদ্যানপ্রাঙ্গণ ভরিয়া যাইবে না, এমন প্রতিশ্রুতি কে দিবে? অন্যান্য রকমারি জিনিসপত্রও উদ্যানে প্রবেশের আগেই জমা রাখিতে হইবে বলিয়া আদালত নির্দেশ দিয়াছে। সেই সঙ্গে মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির গাছপালা, উদ্যানের ফুল-পাতা ইত্যাদি টানাছেঁড়া না করার জন্য বিশেষ নজরদারি ও কড়া শাস্তির বিধানও দেওয়া হইয়াছে। ইহা ঠিক সিদ্ধান্ত।
উদ্যানের পূর্ব দিকে বহমান গঙ্গার কূলে ভাঙিয়া পড়া জেটির নবনির্মাণের নির্দেশটিও জরুরি। ইহাতে ওই জেটি ব্যবহারযোগ্য হইবে, কলিকাতার দিক হইতে দর্শনার্থীরা নৌকাযোগে খেয়া পার হইয়া বাগানে আসিতে পারিবেন এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন, অব্যবহৃত জেটিটি সহসা সমাজবিরোধীদের আখড়া হইয়া উঠিতে পারিবে না। উদ্যানের ভিতর ছড়াইয়া থাকা বেশ কিছু ভাঙাচোরা প্রাচীন বাড়িও বিশেষজ্ঞ দ্বারা পর্যবেক্ষণ করাইয়া হয় ‘হেরিটেজ-ভবন’ রূপে সংস্কার করার নতুবা ভাঙিয়া ফেলার নির্দেশটিও প্রাসঙ্গিক। আদালতের এই সক্রিয়তা শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হইবে কি না, তাহা অবশ্য বহুলাংশে নির্ভর করিতেছে উদ্যান কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার উপর। উদ্যানটির অধঃপতনের পিছনে কর্তৃপক্ষের দায়ই ছিল প্রধান। তাঁহারা পুরসভা বা পুলিশের সাহায্য লইয়া ঐতিহ্যপূর্ণ এই উদ্যানের হাল ফিরাইতে সচেষ্ট হন নাই। এখনও তাঁহাদের চেষ্টার উপরেই উদ্যানের ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল। তবে এখন পাশাপাশি সচেতন, সতর্ক পরিবেশবিদরা রহিয়াছেন, এইটুকুই ভরসা। |