আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মার্কিন সাইক্লিস্ট লান্স আর্মস্ট্রং রাতারাতি খলনায়কে পর্যবসিত। শক্তিবর্ধক নিষিদ্ধ ঔষধ সেবন করিয়াই তিনি চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াইয়ে কৃতকার্য হইতেন-- এই অপরাধে তাঁহার গত পনেরো বছরে অর্জিত সমস্ত খেতাব কাড়িয়া লওয়া হইয়াছে। তাহার ফলে অনেকেই হতাশ এবং বিষণ্ণ। হতাশার কারণ, তাঁহার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যাসত্য বিচারের প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হইল না। অনেক দিন ধরিয়াই তাঁহার সম্পর্কে ডোপিংয়ের অভিযোগ উঠিতেছিল, তিনি সেই অভিযোগ অস্বীকার করিয়াছিলেন। এ বার তিনি বলিয়াছেন, আর নয়, তিনি আর কিছুই বলিবেন না। কেন তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন না করিয়া সরিয়া দাঁড়াইলেন, তাহা সংশয়াচ্ছন্ন থাকিয়া গেল। বিষাদের কারণ, ক্যান্সারের মতো মারণ রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করিয়া যিনি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার আসরে সগৌরব ফিরিয়া আসিয়াছিলেন, অসম্মান ও ধিক্কারের মধ্য দিয়া তাঁহাকে নির্বাসনের নিঃসঙ্গতায় পতিত হইতে হইল। এমন পরিণতিতে বিষাদ অনিবার্য।
ভাবিয়া দেখিলে, এই বিষাদের কিছু মাত্র প্রয়োজন ছিল না। আর্মস্ট্রংয়ের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগটির সত্যাসত্য বিচারের সত্যকারের কোনও প্রয়োজনই নাই, কারণ ডোপিং সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাটিই ভুল, অযৌক্তিক। কিছু শক্তিবর্ধক ঔষধকে নিষিদ্ধ করা হইয়াছে, তাই আর্মস্ট্রং নিষেধাজ্ঞার শিকার হইয়াছেন, যেমন তাঁহার আগে আরও অনেক কৃতী খেলোয়াড় হইয়াছিলেন। এই নিষেধাজ্ঞার নীতিই ভ্রান্ত। ‘অস্বাভাবিক’ ভাবে শক্তি বাড়াইয়া তোলে বলিয়া কোনও ঔষধকে নিষিদ্ধ করা হইবে কেন? নিষিদ্ধ ঔষধগুলির বাহিরেও এমন অনেক ঔষধ আছে, যেগুলি শক্তিবর্ধকের কাজ করিলেও নিষিদ্ধ নয়। কিছু বলবর্ধক নিষিদ্ধ, কিছু নয়। এই বিভাজন সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, অবান্তর, যথেচ্ছাচারী। ঔষধ এবং প্রযুক্তির যত উন্নতি হইতেছে, ততই এই বিভাজনের যৌক্তিকতা কমিয়া যাইতেছে। বহু ক্ষেত্রেই হয়তো এমন অনেক ঔষধ ব্যবহার করা হইতেছে, যাহা পরীক্ষায় ধরা পড়ে না। সুতরাং, ধরা পড়ে না বলিয়া, ‘অপরাধী’ পার পাইয়া যাইতেছেন। স্পষ্টতই, সমগ্র ব্যবস্থাটিই রদ করা দরকার।
নিষেধাজ্ঞার সপক্ষে বলা হইয়া থাকে, নিষিদ্ধ ঔষধপত্র খেলোয়াড়কে সাময়িক ভাবে শক্তি, স্ফূর্তি ও দম সরবরাহ করিলেও আখেরে তাহার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিই সাধন করে। পদক জয়ের উত্তেজনায় ক্রীড়াবিদ কিংবা তাঁহার প্রশিক্ষকের এই সমূহ ক্ষতির কথা খেয়াল থাকে না, কিন্তু ক্ষতি যাহা হওয়ার, হইয়াই যায়। এই যুক্তি দুর্বল, ভ্রান্ত। প্রথমত, নিষিদ্ধ তালিকাভুক্ত নয়, এমন অনেক ঔষধ-ইঞ্জেকশনও একই ধরনের ক্ষতিসাধন করে। বস্তুত, অ্যান্টিবায়োটিক-সহ বহু অতিপ্রচলিত ঔষধও দীর্ঘমেয়াদি বিচারে শরীরের নানা ক্ষতি করিয়া থাকে। দ্বিতীয়ত, খেলোয়াড়রা যেখানে নিজেদের অজ্ঞাতসারে কিছু করিয়া ফেলিতেছেন না, সব জানিয়া-বুঝিয়াই শক্তিবর্ধক ঔষধ সেবন করিতেছেন, সে ক্ষেত্রে সেই ঝুঁকি লওয়ার স্বাধীনতা তাঁহাদের মঞ্জুর করা হইবে না কেন? যদি কেহ মনে করেন, তিনি ওই সব ঔষধ-ইঞ্জেকশন লইয়া চ্যাম্পিয়ন হইবেন, তাঁহাকে সেটা করিতে দেওয়া হউক। যে খেলোয়াড় শরীরের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির ভয়ে বা অন্য কারণে তেমন বলবর্ধক সেবন করিতে নারাজ, তাঁহাকে ‘আপন’ শক্তিতেই প্রতিযোগিতা করিতে হইবে, কারণ উহা তাঁহারই সিদ্ধান্ত। ক্রীড়া-প্রতিযোগিতার পরিচালকদের ডোপিং সংক্রান্ত মান্ধাতার আমলের বিধিটি রদ করার সময় আসিয়াছে। সর্ব স্তরের প্রতিযোগিতায়ই বলবর্ধক ঔষধ সেবনের অধিকার শিরোধার্য হওয়া উচিত। একটি নিয়ম চলিয়া আসিতেছে বলিয়াই চলা উচিত, ইহা কোনও যুক্তি হইতে পারে না। লান্স আর্মস্ট্রংয়ের পরিণতি একটি নূতন যুগের সূচনা করুক। স্বাধীনতার যুগ। খেলোয়াড়ের স্বাধীনতা। |