আচমকা দুর্ঘটনা ঘটলে মুহূর্তের মধ্যে মাথার পাশে চলে আসবেন চিকিৎসক। অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে শুরু করে প্রাথমিক চিকিৎসার যাবতীয় সরঞ্জাম হাতের কাছেই মজুত থাকে। আহতকে অবিলম্বে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার হলে হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুল্যান্স আসার অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় না চিকিৎসক ও রোগীকে। কারণ, আধুনিক অ্যাম্বুল্যান্সও রয়েছে নিজেদের। মাত্র পাঁচ-ছ’কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে পৌঁছতে সময় লাগে দশ থেকে পনেরো মিনিট।
নিকো পার্কের দুর্ঘটনার পরে কলকাতা শহর ও শহরতলির বিনোদন পার্ক ঘুরে যে ঢিলেঢালা চিত্র চোখে পড়েছে, ঠিক তার উল্টো এই তথ্য পাওয়া গিয়েছে ভারতের কিছু প্রথম সারির বিনোদন পার্কের কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে। মুম্বইয়ের অদূরে গরাই এলাকায় ‘এসেল ওয়ার্ল্ড’ এবং
কোচিন শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরের ‘ওয়ান্ডার লা’ বিনোদন পার্কের কর্তারা ইতিমধ্যেই জেনে গিয়েছেন নিকো পার্কের ঘটনার কথা। ‘এসেল ওয়ার্ল্ড’-এর মার্কেটিং বিভাগের প্রধান ভূষণ মুথওয়ানিকে ফোনে ধরতেই
তিনি বলেন, “এখন কেমন আছেন অসুস্থেরা?”
কেন এই পরিকাঠামোর তফাৎ? তা হলে কি বিনোদন পার্কের ‘অবশ্য কর্তব্য’ হিসেবে নির্দিষ্ট কোনও নিয়মাবলি নেই? ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর অ্যামিউজমেন্ট পার্ক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ’ (আইএএপিআই)-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট যোগেশ ডাঙ্গে জানান, ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডসের কিছু নিয়ম রয়েছে। প্রতিটি বিনোদন পার্কের সেই নিয়ম মেনে চলার কথা। তাঁর কথায়, “নিকো পার্ক-সহ দেশের বেশির ভাগ পার্কই তা মেনেও চলে। কিন্তু, দুর্ঘটনার উপরে তো কারও হাত নেই।” কেন হল এই দুর্ঘটনা? ডাঙ্গে বলেন, “অত্যধিক ভিড়ের চাপে কিছু রাইড ভেঙে পড়তে পারে। এক-একটি রাইডের ধারণ ক্ষমতা এক-এক রকম। চাপ বেড়ে গেলে এমন দুর্ঘটনা সম্ভব। তবে, প্রতি দিন হাজার হাজার মানুষ দেশের কত বিনোদন পার্কে যাচ্ছেন। কতগুলো এমন দুর্ঘটনার কথা আপনারা শোনেন?”
ডাঙ্গের কথা থেকে স্পষ্ট, নিয়মাবলি থাকলেও তা মেনে চলাটা সেই নির্দিষ্ট পার্ক কর্তৃপক্ষের উপরে নির্ভর করে। অনেক ছোট-ছোট বিনোদন পার্ক গজিয়ে উঠছে, যাদের নিজস্ব অ্যাম্বুল্যান্স রাখার সামর্থ নেই। অ্যাম্বল্যান্স বা জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থা রাখতেই হবে এমন কোনও নিয়মও সরকারের তরফে বেঁধে দেওয়া নেই। তাই, বছরে এক বার স্থানীয় স্বাস্থ্য দফতরের লাইসেন্স নবিকরণের সময়ে ‘ফার্স্ট এড’ বাক্স দেখালেই কাজ হয়ে যায়। একই ভাবে মিলে যায় পূর্ত, দমকল, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ছাড়পত্র। হাওড়ার বেলিলিয়াস পার্কের মতো অনেকে এখনও এই অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য নন। সে ক্ষেত্রেও বাধ্যতামূলক কোনও নিয়ম নেই।
এসেল ওয়ার্ল্ডের ভূষণ মুথওয়ানিও মনে করেন, নিকো পার্কের দুর্ঘটনা বেশি লোক চড়ার জন্যই হয়েছে। তাঁর কথায়, “কোনও রাইডে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে সামান্য বেশি লোক উঠলেও তা থেকে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আমরা এ ক্ষেত্রে কোনও আপস করি না। মানুষ অনেক ক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে অধৈর্য্য হয়ে যান ঠিকই, সেই কারণে জনপ্রিয় রাইডের সামনে ‘রেন ডান্স’-এর মতো অন্য ধরনের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাও রাখা হয়।” তিনি জানান, ছুটির দিনে গড়ে তিন থেকে চার হাজার মানুষ ঢুকে পড়েন দেশের প্রাচীনতম এই বিনোদন পার্কে।
তিন-চার মাস অন্তর বন্ধ রেখে সমস্ত রাইড রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় বলে জানিয়েছেন বিনোদন পার্ক ‘ওয়ান্ডার লা’-এর এমডি অরুণ চিট্টিলাপিল্লাই। কোচি ছাড়াও বেঙ্গালুরুতেও ওয়ান্ডার লা-এর একটি পার্ক রয়েছে। এই দুই পার্কেই ‘সুপার জাম্পার’, ‘ভিনটেজ টর্নেডো’, ‘থান্ডার ফল’-এর মতো ঝুঁকিপূর্ণ রাইড রয়েছে। অরুণের কথায়, “রাইডগুলি ঠিক ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে কি না, সেগুলি থেকে কোনও দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করতে ইন্টারন্যশনাল স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশন (আইএসও)-এর থেকে সার্টিফিকেট নেওয়া হয়। এখনও পর্যন্ত আমাদের পার্কে কোনও বড় দুর্ঘটনা ঘটেনি। তবুও আমরা তো ঝুঁকি নিতে পারি না। চিকিৎসক, নার্স, সরঞ্জাম, অ্যাম্বুল্যান্স সবই রয়েছে।”
ভূষণ জানান, এসেল ওয়ার্ল্ডের যে ৫০টি রাইড রয়েছে, সেগুলি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রীতিমতো মাইনে করা ইঞ্জিনিয়ারও রয়েছেন। তিনি বলেন, “আমাদের বেশির ভাগ রাইড তা বিদেশ থেকে আমদানি করা। সে ক্ষেত্রে ‘টিইউভি’ নামে এক সংস্থার ছাড়পত্র লাগে। কেনার সময়েই ঠিক হয়ে যায় যে, কত দিন অন্তর রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন। সেই রুটিন থেকে হেরফের হলে সার্টিফিকেট বাতিল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।”
নিকো পার্কের ঘটনার কারণ জানতে চেয়েছে অ্যাসোসিয়েশন। ডাঙ্গে-র কথায়, “ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা এড়াতে নিকো পার্কের দুর্ঘটনার কারণ জানাটা আমাদের কাছেও জরুরি।” |