ঘটনা ঘটলে টনক নড়ে। সাধারণত এটাই দস্তুর।
কিন্তু, দুর্ঘটনার পরেও হেলদোল নেই কর্তৃপক্ষের, এমন উদাহরণ বিরল! কলকাতা ও শহরতলির দু’টি বিনোদন পার্কে এমনই নজিরবিহীন গা-ছাড়া ভাব। নিকো পার্কের ঘটনায় এখনও আতঙ্ক কাটেনি। কিন্তু সেই ঘটনা থেকেও যে তাঁরা শিক্ষা নিতে নারাজ, রাজারহাটের অ্যাকোয়াটিকা এবং হাওড়ার বেলিলিয়াস পার্ক কর্তৃপক্ষের মনোভাবেই তা স্পষ্ট।
দু’টি বিনোদন পার্কেই এমন সব রাইড রয়েছে, যা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। দু’টি পার্কের কর্তৃপক্ষ যতই পূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণের দাবি করুন না কেন, দুর্ঘটনা যখন খুশি ঘটতে পারে। আর তা হলে আপৎকালীন ব্যবস্থার সরেজমিন যে চিত্র উঠে এসেছে, তা যথেষ্ট ভীতিজনক।
অ্যাকোয়াটিকা থেকে নিকটবর্তী হাসপাতালের দূরত্ব অন্তত আধ ঘণ্টার। দুর্ঘটনার পরে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে কোনও অ্যাম্বুল্যান্স নেই। আছে সাকুল্যে একটি ভ্যান। অ্যাম্বুল্যান্স নেই বেলিলিয়াস পার্কেও। সেখান থেকেও কাছের হাসপাতাল পৌঁছতে কুড়ি মিনিট লাগবেই।
দুই বিনোদন পার্কে কোনও চিকিৎসক নেই। অ্যাকোয়াটিকায় প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র বলতে যে ঘরটি আছে, তাতে একটি মাত্র শয্যা। সঙ্গে ব্যথা কমানোর স্প্রে আর মলম। বেলিলিয়াস পার্কে ভরসা বলতে একটিমাত্র ‘ফার্স্ট এড’ বক্স। তাতে তুলো, গজ, বেঞ্জিন আর ডেটল রয়েছে। অথচ এই পার্কে এমন কিছু ‘বিপজ্জনক’ রাইড রয়েছে, যে ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটলে হাত-পা ভাঙা বা মাথা ফাটার যথেষ্ট সম্ভাবনা। |
বেলিলিয়াস পার্কের রাইড।
|
অ্যাকোয়াটিকায় প্রাথমিক চিকিৎসার হাল
|
|
অ্যাকোয়াটিকা কর্তৃপক্ষের দাবি, সাধারণত হাত-পা মচকানো বা ছোটখাটো কাটা-ছেঁড়ার ঘটনাই ঘটে। ঘটনার গুরুত্ব বুঝে ডাকা হয় অ্যাম্বুল্যান্স। কিন্তু, অ্যাম্বুল্যান্স পৌঁছতে তো কম করে আধ ঘণ্টা লাগবে? কোনও সদুত্তর মেলেনি। বেলিলিয়াস পার্কের জিএম শ্যামলী চক্রবর্তীর কথায়, “ফার্স্ট এড বক্স দিয়েই প্রাথমিক চিকিৎসা হয়। বড় দুর্ঘটনায় কোম্পানির গাড়ি করেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।”
অ্যাকোয়াটিকা পার্কের জিএম অনশুল শর্মার দাবি, তাঁদের পার্কে বিপজ্জনক কোনও রাইড নেই। স্লাইড রাইডগুলিতে দশ-বারো জন নিরাপত্তাকর্মী নজরদারি চালান। নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি এক জনকেও রাইডে উঠতে দেওয়া হয় না। তাই বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা কম। বেলিলিয়াস পার্কে রিভার কেভ, হ্যাং গ্লাইডার, সুইং চেয়ার, ফিশ বেন, স্টিয়ারিং কার, ড্রাগন ট্রেন-এর মতো নানা ঝুঁকিবহুল রাইড আছে। যা থেকে যে কোনও মুহূর্তে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা। পাশাপাশি, ওই পার্কে আর একটি যে ‘বিপজ্জনক’ বিনোদনের ব্যবস্থা আছে, তা হল পার্কের প্রায় অর্ধেক জুড়ে থাকা ২০ ফুট গভীর লেক। বোটিং করতে গিয়ে ডুবে গেলে উদ্ধারের জন্য নেই প্রশিক্ষিত ডুবুরি, অক্সিজেন সিলিন্ডার বা মাস্ক।
দুই পার্কের কারওরই ‘ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশন’ (আইএসও)-র সার্টিফিকেট নেই। নিরাপত্তার প্রশ্নে যে কোনও বিনোদন পার্কের জন্য যা জরুরি। আইএসও সার্টিফিকেট ছাড়াই ১২ বছর ধরে পার্ক চলছে? অনশুলবাবুর কথায়, “বছর দুই আগে আইএসও-র সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করা হয়েছে। এখনও পাওয়া যায়নি।”
অথচ এই শহরেই রয়েছে ভিন্ন এক চিত্র। কলকাতার সায়েন্স সিটিতে বিপজ্জনক রাইড বলতে একমাত্র রোপওয়ে। তবুও আছে রেড ক্রস অনুমোদিত প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র। রয়েছেন প্রশিক্ষিত নার্স। পার্কের রোপওয়েটি চালুর আগে প্রতিদিন ‘ডামি রান’ হয়। সায়েন্স সিটির অধিকর্তা অরিজিৎ দত্তচৌধুরীর কথায়, “আমাদের চিকিৎসা কেন্দ্রে রক্তচাপ মাপা থেকে শুরু করে অক্সিজেন সবই রয়েছে। কেউ অসুস্থ হলে প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র তো আছেই, তা ছাড়া আমাদের ঠিক করা হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুল্যান্স ডেকে নেওয়া হয়।” সেই হাসপাতালের দূরত্ব বড়জোর দশ মিনিট।
|
ছবি: দেবাশিস রায় ও দীপঙ্কর মজুমদার |