|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় গল্প |
জলঙ্গি |
অমিতাভ সমাজপতি |
জলঙ্গি মরে যাচ্ছে। জলঙ্গি একটি নদীর নাম। জলঙ্গি তেহট্টে।
আমি গাড়িতে এই তীব্র গরমে ফুল এসি
চালিয়ে যাচ্ছি ওই নদী নিয়ে বক্তৃতা করতে এবং ঠিক বুঝতে পারছি না আমার এই বক্তৃতায় জলঙ্গি কী করে বাঁচবে?
তেহট্টে আমার শালির বাড়ি। তিনি প্রায় আমার মায়ের বয়সি। আমার স্ত্রী তাঁর হাতেই মানুষ।
বলতে গেলে ওটা আমার শ্বশুরবাড়িই। যদিও ও জায়গাটায় আমি সবার প্রিয় মেসোমশাই। মেসো কলকাতায় থাকেন। কিঞ্চিৎ সাহিত্য করেন, কাগজে নাম ওঠে। তাই ওই দূর প্রান্তিক গ্রামসদৃশ মফস্সল শহরে আমি।
স্যর আপনি ওখানে কেন যাচ্ছেন? ড্রাইভার উৎসুকে প্রশ্নটা করল।
আমি বললাম, জামাইষষ্ঠীর নেমন্তন্ন।
সে তো অনেক দেরি স্যর! আমিও তো
নতুন জামাই!
উত্তর না দিয়ে আমি জলঙ্গি নদীর উপর আমার আসন্ন বক্তৃতাটায় মনোসংযোগ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু জলঙ্গি তার সমস্ত স্নিগ্ধতা সহ উধাও হয়ে আমার চোখে ভেসে উঠল রায়বাবুর মুখ। রায়বাবু আমার ভায়রার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। বহু দিনের পরিচয়। কাল রাতে ফোন করেছিলেন। দাদা কাল আসছেন তো? বাঁচান দাদা! আমাদের বাঁচান!
আমি ভাবলাম জলঙ্গির উপর তাঁর আশৈশবের অগাধ ভালবাসা তাই অমন আকুতি। একটি নদী মরে গেলে তার জনপদটিও মূল্য হারায়। নদীমাতৃক এই দেশ...
কিন্তু না, তিনি বললেন অন্য এক গাথা। এ গাথার জন্য আমি তৈরি ছিলাম না।
আসলে রায়বাবু দেনার দায়ে তাঁর বসত ভিটের অর্ধেক অংশ বেচে দিচ্ছেন। এখন মুশকিল হল প্রায় বছর দশেক আগে ওখানেই একটি ভাড়াটে বসিয়ে নিজের সর্বনাশটিও করে রেখেছেন। পি ডব্লিউ ডি-র রাস্তায় পাশেই রায়বাবুর ভিটে। সেখানে তার নিজের ছোট একটি কারখানা। দু’টি লেদ মেশিন নিয়ে নিজের হাতে কাজ করে ডাল-রুটির সংস্থান করেন। তাঁর কারখানার পাশেই সেই ভাড়াটে। এখন জমি বিক্রির সময় সেই ভাড়াটে লোকটা মোটা টাকা দাবি করছে। রায়বাবুর সেটা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। তিনি থানায় গিয়েছিলেন।
কোনও লাভ হল না দাদা। থানা সেই থানাই রয়েছে।
এ বার আমি অধৈর্য হলাম, বললাম, তা আমি কী করব?
রায়বাবু বললেন, বলছি কী দাদা, আপনি তো কাল জলঙ্গি নিয়ে এখানে বক্তৃতা করতে আসছেন, আমন্ত্রণপত্রে আপনার নাম দেখলাম একেবারে এস ডি ও সাহেবের পাশেই... আপনি যদি সাহেবকে...
জলঙ্গিকে প্রথম দেখেছিলাম সে অনেক কাল আগে। তখন আমি নব্যপ্রেমিক। আমার আজকের স্ত্রী অর্থাৎ সেদিনের প্রেমিকার সঙ্গে ঘুরে বেড়াই সারাদিন এ দিক ও দিক। ভিক্টোরিয়া, ইডেন গার্ডেন্স ঘুরেও ঠিক মনের মতো জমছে না। তাই জমাবার জন্য প্রেমিকার দিদির বাড়ি তেহট্ট। দিদি সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। তার স্বামীটি সদাশিব।
এমন একটা টালমাটাল, আঁঠাল-কাঁঠাল পরিস্থিতিতে আমরা দু’জন এসে দাঁড়িয়েছিলাম ওই জলঙ্গি পথে।
ছোট্ট নদী। এ পথে বাঁশ বন আর ইতিউতি গাছগাছলা, ঝোপঝাড়। ও পথে সবুজ ধানের খেত। মাঝে হাল্কা সবজে নীল জল। সে জলে নৌকো চলছে বেশ। ছোট্ট একটা নৌকো নিয়ে ভেসে গিয়েছিলাম যত দূর চোখ যায়। ছলাৎছল জলে আমাদের নৌকো চলেছিল পুব দিকে। দু’দিকের প্রতিটি জনপদে ছিল খেয়া পারাপারের ঘাট। ইস্কুলের ছেলেমেয়েদের কলকলধ্বনিতে আর হাজারো ব্যাপারির সম্ভারে কী এক মহাযুদ্ধের আভাস। পাটের মস্ত নৌকা চলেছে। মাঝিরা গান ধরেছে। লাল বিকেলের বাঙাল জলে জলপোকারা খেলছে অস্থির হয়ে। কত লোক যে দাপিয়ে স্নান করছে। আর কত কত জাল পেতে জেলেরা ধরছে চিংড়ি...। |
|
আজ প্রায় পনেরো বছর যাই না। ঝিরঝিরে সবুজ সাপের ফণার মতো ঢেউ নাকি কচুরিপানায় বন্দি। জলঙ্গির সেই বিখ্যাত চিংড়ি শুনলাম মহাপ্রস্থান করেছে। নদীর নৌকোরা ভেঙেচুরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে পাড়ে পরাজিত মৃত সৈনিকের মতো। জলে দুর্গন্ধ। দু’ধারে নোংরা আবর্জনা।
মনটা খারাপ হল খুব। তাই রাজি হয়ে গেলাম নদী উদ্ধারে।
একটি নদী মজে যায় ভূপ্রকৃতির এক এক আশ্চর্য কারণে। আপনারা জানেন উত্তর ভারতের প্রায় সব নদীই পূর্ববাহিনী। কিন্তু কী এক অদ্ভুত কারণে আপনাদের এই জলঙ্গি পশ্চিমবাহিনী। শুরু পদ্মা থেকে তার পর এঁকে বেঁকে নদিয়ায় এসে গঙ্গায় ঝাঁপ। এখন দেখতে হবে যে নদী আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে অতীব নাব্য ছিল; এমনকী এর কুলে ছোট ছোট স্টিমার চলত। এর দু’ধারের শস্য, মাছ এই সব নিয়ে এক উৎকৃষ্ট জনপদের দিশারি ছিল সে হঠাৎই...
ভদ্রলোক নদী বিশেষজ্ঞ। আমার বিশেষ পরিচিত। তিনি তাঁর প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য দিয়ে বোঝাচ্ছিলেন জলঙ্গির মৃত্যুগাথা।
একেবারে মাঝে বসে আছেন সেই রায়বাবু। তিনি হলেন আমার ভায়রার অভিন্নহৃদয় বন্ধু। কত আদর, ভালবাসা পেয়েছি ওঁর কাছে, আর আজ বসে আছেন আমার কৃপা প্রার্থনায়। তাঁর পাশেই তাঁর স্ত্রী। আমি তাদের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। আজ সকালে এখানে এসে পৌঁছতেই হাউমাউ করে কেঁদে ভদ্রমহিলা প্রায় আমার পায়ে পড়ে গিয়েছিলেন... আমাদের বাঁচান! আমি কী বলব? লজ্জায় চোখ নামিয়ে তাঁদের উঠোনটির দিকে। চমৎকার নিকোনো উঠোন। বড় দুটো আম গাছ। এর কত আম খেয়েছি। এ বার ফলন কম তবুও যথেষ্ট আমের শোভায় যেন এক রাজার কানন। মাঝে কাঁঠাল গাছে উপচানো কাঁঠাল। বড় একটা বাতাবি লেবুর গাছ। দশ-বারোটা নারকেল গাছ আর অজস্র ফুলের সমারোহ। এখন আমার কোল ঘেঁষে বসে আছেন এস ডি ও সাহেব। তার প্রগাঢ় সরকারি গাম্ভীর্যে আমি প্রথম থেকেই মঞ্চে সংকুচিত হয়ে রয়েছি। আমার সামনের সিটের এক নদী দম্পতি অসহায় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
বক্তা এখন তীব্র বেগে এগোচ্ছেন পৃথিবীর সমস্ত নদী চরিত্র এবং তাদের সংরক্ষণের ইতিহাসে। কী ভাবে চিনের হোয়াং হো, মিশরের নীলনদ অথবা ইউরোপের দানিয়ুবকে বাঁচানো হচ্ছে।
আমি চকিতে তাকালাম প্রেক্ষাগৃহের বাঁ দিকে। একটা হাত উঠেছে। ভাল করে চেয়ে দেখলাম ওটা স্বপন। আমি যাদের মেসোমশাই হই তাদের বন্ধু। থাকে বড় রাস্তার উপর। বহু কাল বেকার থাকার পর সম্প্রতি বাদকুল্লায় একটা স্কুলে চাকরি পেয়েছে। বড় আশা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সেও এক কাহিনি। আমি এখানে আসছি জেনে স্বপন একটা চিঠি পাঠিয়েছিল আমায়। রোজ প্রায় একশো কিলোমিটার বাস জার্নি করে বাদকুল্লা যাওয়া। চাকরি করা তার শরীর আর দিচ্ছে না। ও দিকে কিডনির অসুখে ভুগছে সে। রোগা শরীর আরও নানান অসুখে বেসামাল। তার একমাত্র আশা বাদকুল্লা থেকে তাকে ট্রান্সফার করে তেহট্ট স্কুলে নিয়ে আসা। তাই আমার দিকে তীর্থের কাকের মতো বসে আছে। ও নদী এখনও মজেনি... তবে আমি বুঝতে পারছি তার মজা শুরু হয়েছে। অথচ স্বপন ছিল তেহট্ট-এর এক নম্বর ফুটবলার। ডাকাবুকো সুঠাম চেহারার দামাল ছেলে, স্বপ্ন দেখত কলকাতার বড় ক্লাবে খেলবে।
বক্তা এখন করজোড়ে প্রার্থনা করছেন যে ভাবেই হোক জলঙ্গিকে বাঁচাতেই হবে প্রথমত এর নাব্যতা বাড়াতে হবে। নাব্যতা বাড়াতে হলে...
আমি নদী বিজ্ঞানে মনোযোগ দেব ভাবছি, এই সময় আমার চোখ পড়ল প্রেক্ষাগৃহের ডান দিকে। দেওয়াল ঘেঁষে বসে আছে দেবু। দেবু সুন্দরবনের মধু সংগ্রাহক ও চাষি। ওর মামাবাড়ি ওই অঞ্চলে। মাঝে মধ্যে গভীর রাতে ওর ফোন পাই, মেসো, একটা তাঁবুতে শুয়ে বই পড়ছি। এইমাত্র দূরে
বাঘের গর্জন শুনলাম। জীবনটা হাতে নিয়ে পড়ে থাকি এখানে।
সেই দেবু এখন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দেবু গল্প লেখে। শখের গল্পকার। আমার লেখার এক নম্বর সমালোচক, ভক্তও। এক দিন ও একটা গপ্প লিখে আমার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। সে গল্প ঠিক গল্প নয়। গল্পের আড়ালে এক নিদারুণ আকুতি একটা ভদ্রস্থ চাকরির প্রার্থনা। আমি আকুতিটা না বোঝার ভান করে শুধু গল্পটাকে ভাল বলে এড়িয়ে গিয়েছিলাম।
অল্প বয়সে দেবুকে জিজ্ঞেস করতাম, ভবিষ্যৎ প্ল্যানিং কী? দেবু হেসে বলত, তেহট্ট নিয়ে একটা উপন্যাস লিখব। কোনও প্রাইমারি স্কুলে পড়াব। আর রিনাকে বিয়ে করব। আর জীবনে একটু আলো আনব মেসো। জানেন তো, আমাদের বাড়িতে ইলেকট্রিক নেই...।
গাড়িটা বেগে ছুটছে কলকাতার দিকে। আমি ইতিমধ্যেই জেনে ফেলেছি যে, যেহেতু জলঙ্গি পদ্মার শাখা নদী, এবং যেহেতু ফরাক্কার বাঁধ, তাই পদ্মার জল নেমে গিয়েছে নীচে। জলঙ্গিও জলহারা। হাজার চেষ্টায় আর সেখানকার জল ফিরবে না।
চাকদা ছাড়াল। আমি বললাম, ভাই গাড়িটা একটু জোরে চালাও।
কেন স্যর, জোরেই তো চলছে।
না, তুমি স্পিড বাড়াও।
ড্রাইভার বোধ হয় খুশি হল না। তা হোক। তেহট্টের সিনেমা হল পাড়া থেকে গাড়ি স্টার্ট দেওয়া ইস্তক একটা আশ্চর্য গন্ধ আমার পিছু নিয়েছে। সেটা এই সারা নদিয়া জেলায় ছড়িয়ে রয়েছে। এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালাতে হবে এ বার গাড়ি ছুটল আরও জোরে। কাল রাতে হোটেলে বিশ্রাম নিচ্ছি। বেয়ারা এসে বলল, কে একটা মেয়ে নাম বলছে নন্দিতা। আপনাকে চেনে। আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, কাল ভোরবেলা যেন দেখা করে। আমি এখন খুবই ক্লান্ত।
বেয়ারা চলে গিয়েও আবার ফিরে এল। বলল, মেয়েটা দেখা করবেই বলছে। আপনি নাকি ওর মেসো হন। আমি তো সারা তেহট্টেরই মেসো মনে মনে ভাবলাম। তার পর বিরক্ত হয়ে বললাম ডাকো...
চিনতে পারছেন মেসো?
আমি অবাক হয়ে তাকালাম দরজার দিকে। সেখানে একটি মেয়ে। লাজুক, অপ্রতিভ সবুজ রঙের শাড়ি। সে সবুজ কাঁঠাল পাতার না কুমড়ো পাতার বুঝতে পারলাম না।
আমি নন্দিতা। আপনি আমাকে নন্দিনী বলে ডাকতেন।
আমি তবু তাকিয়েই রইলাম। ভদ্রতা করে হাসলাম।
সে আমার ভাব বুঝতে পেরে বলল, আমি নন্দিতা, ম্লান হাসল সে। আমি মাঠপাড়ায় শশীরঞ্জন ঘোষের মেয়ে নন্দিতা। আমার ভাইয়ের নাম ছিল অনল। খুব কথা বলত বলে ওকে আপনি ডাকতেন অনর্গল বলে।
আমি তাকিয়েই রইলাম। মনে পড়ছে না। মেয়েটা এ বার দরজা ছেড়ে একটু এগিয়ে এল। বলল, আমার অ্যাবরশনটার কথাও ভুলে
গেলেন মেসো!
চমকে উঠলাম। এ বার আমার সংবিৎ ফিরল। তাই তো! সে তো অনেক কাল আগেকার কথা। আমি তখন সদ্যবিবাহিত। এক দিন কলকাতার বাড়িতে ডোর বেল। দরজা খুলে দেখি, এই নন্দিতা। সঙ্গে তার মা। ওরা কোনও কথা না বলে দাঁড়িয়েছিল। আমি একটু আশ্চর্য হয়ে তাকাতে ও বলল, মাসি নেই?
সে তো কাজে ভাই। তোমরা ভেতরে এসে বসো। বসালাম, ওদের মাসি অর্থাৎ আমার ডাক্তার স্ত্রী ফিরল ঘণ্টা দুয়েক পর... তার পর... নন্দিতার অ্যাবরশন। আমরা স্বামী-স্ত্রী দায়িত্ব নিয়ে ঝামেলাটা মিটিয়ে দিচ্ছিলাম। কিন্তু সব কিছু হয়ে যাওয়ার পর ফেরার দিন অদম্য কৌতূহলে শেষ পর্যন্ত আমি জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলাম, কে ওই পাপী?
নন্দিতা মাথা নিচু করে ছিল।
বলো, বলতে তোমাকে হবেই। আমাদের দিয়ে একটা কুৎসিৎ কাজ করালে আর আসল পাপীর...
ওরা বলেনি। নীরবে চলে গিয়েছিল তেহট্টে। যাওয়ার সময় দু’জনেই হাসছিল। আমরা আর যোগাযোগ রাখিনি। ফোন করলেও ধরিনি সেই নন্দিতা! আমি একটু বিরক্ত বোধ করলাম। আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগেকার ঘটনা, তবুও মনটা বিষিয়ে উঠল, বললাম, বলুন...
নন্দিতা আমার আপনি সম্বোধনে চমকে উঠে তাকাল আমার দিকে, মুহূর্তে আবার মাথা নামিয়ে নিল। আমি ওর দিকে অপাঙ্গে তাকালাম। এখন বয়স হয়ে গিয়েছে। কত হবে চল্লিশ তো পেরিয়েইছে। বললাম, বলুন ভাই আমি খুবই ক্লান্ত।
নন্দিতা এ বার সোজাসুজি তাকাল আমার দিকে। চোখ দু’টি তার আগের মতো স্নিগ্ধ। পাতাগুলো ভারী সুন্দর। হালকা মাজিল গায়ের রং ছিল এক সময়। এখন কালো হয়ে গিয়েছে আর তাতে অকাল বার্ধক্যের ছাপ সে একটু চুপ করে থেকে বলল, জানতে চাইবেন না সে দিনের সেই পাপী কে?
আমি মাথা নাড়লাম। বললাম, সুখ করতে গিয়ে মিথ্যে কোনও গল্প ফাঁদোনি, তবু ভাল। আমিও সব ভুলে গিয়েছি। নন্দিতা এ বার আবার চোখ নামিয়ে নিল। সেই সবুজ শাড়ি আর লাল ব্লাউজ, ডাগর চোখ নিয়ে সে এগিয়ে এল আমার কাছে, বলল, জানেন মেসো আমার একটা ভাই ছিল অনল, যাকে আপনি অনর্গল বলে ডাকতেন। জানেন মেসো। ও এক দিন পাগল হয়ে গেল। বদ্ধ উন্মাদ। চাকরির খোঁজ করতে করতে। সেই দামাল পাগলকে কে সামলাবে? আমিই ওটা করতাম। একমাত্র আমার কথাই শুনত। আমার হাতেই খেত, ওষুধপথ্য। আমি মাথায় হাত না বুলিয়ে দিলে ঘুমোতো না। আমরা তো পিঠাপিঠি ভাইবোন। একসঙ্গে এক ঘরে থাকতাম। রাতে এক বিছানায়। এক দিন কী মনে হল... ও তখন উত্তঙ্গ আর আমার মনে হল একটি সুস্থ যৌনতাই হয়তো ওকে স্বাভাবিক করে দিতে পারে। তার পর... পর দিন সকালে একদম সুস্থ। কেবল চুপ করে বসে রইল আর আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তার পর এক রাতে সোজা কড়িকাঠে ঝুলে পড়ল... যাওয়ার আগে একটা ছোট্ট চিরকুট দিদি, আমায় ক্ষমা করিস।
ডুকরে কেঁদে উঠল নন্দিতা। আমি স্তম্ভিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। সে কাঁদছে আর বলছে আপনি তো পাপীর নাম জানতে চেয়েছিলেন মেসো, বলুন তো সে পাপী না আমি? বলুন, বলুন। বলতে বলতে সে আমার নিশ্বাসের দূরত্বে এগিয়ে এসেছিল, তখনই এই গন্ধটা পাই ওর মুখে। নন্দিতা বলল, কত বার ফোন করেছি আপনাকে, মাসিকে, ধরেননি। আর আজ জলঙ্গি বাঁচাতে এসেছেন? হাঃ জানেন না জলঙ্গির বুকের উপর কংক্রিটের ফরাক্কা বাঁধ। তার পর টেবিলে রাখা আমার সিগারেটের প্যাকেটটা থেকে একটা সিগারেট নিয়ে অভ্যস্ত হাতে ধরিয়ে বলল, তার পর বাবার অসুখ। সংসারে দুটো বোন একটা ছোট ভাই। সে ধোঁয়া ছাড়ল ইচ্ছে করেই আমার মুখে।
তুমি সিগারেট খাও?
নন্দিতা হেসে বলল, ক্লায়েন্টরা আবদার করে তো মেসো।
গাড়িটা এখন হাওয়ায় বেগে ছুটছে আর তার পিছনে শয়ে শয়ে জলঙ্গি ধেয়ে আসছে আমার পিছনে। তাদের জল নেই ঢেউ নেই কোনও মাছ নেই, নৌকো নেই চারিদিকে কচুরিপানা আর রাজ্যের আবর্জনা ভাঙা হাড়ি-পাতিল,
প্লাস্টিকের স্তূপ...
আমি বললাম নদী, তোমার বুকে ও সব কেন?
নদী হেসে বলল, ক্লায়েন্টরা আবদার
করে যে মেসো।
নদিয়া ছাড়িয়ে গাড়ি এখন এগোচ্ছে কলকাতার দিকে। জলঙ্গি বোধ হয় আর পিছনে নেই। গন্ধ নেই। আর ধাওয়া করছে না আমায়। বললাম, নদী তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?
নদী হা হা করে হেসে উঠল। বলল, জটা হইতে নদীর জন্ম! হা হা হা, রুক্ষশুষ্ক উকুনে ভর্তি এক নিরস চুলের পিণ্ড থেকে নদীর জন্ম! হা হা তা হবে। মহান ভারতবর্ষ বলে কথা...
গাড়িটা হাইওয়ে দিয়ে উল্কার বেগে ছুটছে। আর কোনও ভয় নেই। কোনও গন্ধ নেই। শুকনো জলঙ্গি এখন আমাদের অনেক পিছনে। অনেক।
|
|
|
|
|
|