|
|
|
|
|
|
|
বাঙালির আপন বৃন্দাবন |
জনশূন্য জঙ্গলময় বৃন্দাবনে রাধাকৃষ্ণকে ফিরিয়ে এনেছিল বাঙালি, সার্থক হয়েছিল
শ্রীচৈতন্যের স্বপ্ন। আকবরের সময় থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত ব্রজধামের মন্দিরে হাভেলিতে
বাঙালির রমরমা। আর আজ? বৃন্দাবনে বাঙালির ইতিহাস খুঁজেছেন ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী |
|
“বৃন্দাবনের মন্দির শূন্য, পরিত্যক্ত, ভগ্ন। নাটমন্দির, জগমোহন, সিংহদ্বার, গর্ভগৃহ বাদুড় চামচিকের অধিকারে।... পরিত্যক্ত দেউলে ভক্তের আনাগোনা নেই। সন্ধ্যারতির ঘণ্টা এখন বাজে অন্যত্র। সেখানে পূজা-উপঢৌকনের ফল মেলে হাতে হাতে। সেখানে পুণ্যলোভীর ভিড় সূচীভেদ্য।”
(তারাপদ মুখোপাধ্যায়, ‘নিজ প্রিয় স্থান আমার মথুরা বৃন্দাবন’)। |
|
এ কোন বৃন্দাবন? বৃন্দাবনের কথা ভাবলেই বাঙালির মনে যে ছবিটা ভেসে ওঠে, সেখানে এক দিকে চিরপরিচিত পদাবলি-কীর্তনের বৃন্দাবনবিলাসিনী রাই আমাদের, অন্য দিকে বাঙালি বিধবা আর মহাস্থবির জাতক-এর সেই ভিখারিনিরা, যারা ‘ভোর হতে-না-হতেই পালে পালে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়... বিশেষ করে নতুন মুখ ও যাত্রী দেখলেই ছেঁকে ধরে।’ এর বাইরে অন্য কোনও বৃন্দাবন আছে কি? বাঙালির নিজের হাতে গড়া বৃন্দাবন, আর্যাবর্তে বাঙালির একমাত্র কীর্তি?
শ্রীচৈতন্য, ষড় গোস্বামী, আকবর, মানসিংহ, জয়সিংহ, লালাবাবু পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মন্দির আর রিয়েল এস্টেট সমৃদ্ধ একুশ শতকের বৃন্দাবনে সেই অন্য কিছু খুঁজতে গিয়েছিলেন অভিমন্যু আর সুব্রতা দত্ত। ধর্মের জাঁকজমক আর প্রোমোটারির আড়ালে যা তাঁরা দেখেছেন, ছবি তুলে এনেছেন সবাইকে দেখাতে, তা-ও বোধহয় আর বেশি দিন টিঁকবে না। (তাঁদের বৃন্দাবনের ছবির একটি প্রদর্শনীর আয়োজন হয়েছে গ্যালারি গোল্ড-এ, ৮ থেকে ১২ অগস্ট।) এই অন্য বৃন্দাবনকে বুঝতে হলে একটু পিছন ফিরে তাকাতে হবে।
সনাতন গোস্বামীকে চৈতন্য বলেছিলেন, ‘নিজ প্রিয় স্থান আমার মথুরা বৃন্দাবন’। চৈতন্য নিজে বার বার বৃন্দাবনে যেতে চেয়েছেন, প্রথম দু’বার চেষ্টা করেও পারেননি। শেষ পর্যন্ত তিরিশ বছর বয়সে নীলাচল থেকে ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কাশী প্রয়াগ মথুরা হয়ে বৃন্দাবন পৌঁছলেন চৈতন্য, সঙ্গে শুধু বলভদ্র ভট্টাচার্য।
বৃন্দাবন তখন জনবিরল জঙ্গলময়, মন্দির-ঘাট-কুঞ্জ-জনবসতি কিছুই নেই। এত নির্জন যে, চৈতন্য একদিন ভাবাবেশে অক্রূর ঘাট থেকে জলে ঝাঁপ দেওয়ায় বলভদ্র ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, ‘বৃন্দাবনে ডুবে যদি কে উঠাবে তারে’। একটি রাত্রিও চৈতন্য সেখানে বাস করেননি, এসেছেন শুধু দিনের বেলা। তবে এর অর্ধশতকের মধ্যেই বৃন্দাবন আধ্যাত্মিক সম্পদে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। জাগতিক সম্পদও এসেছিল অল্প দিনের মধ্যেই, এতটাই যে জীব গোস্বামীর মৃত্যুর (১৬০৮) কিছু দিনের মধ্যেই মন্দিরে মন্দিরে ঈর্ষা ও দলাদলি শুরু হয়ে গিয়েছিল। মধ্যযুগে কাশী-মথুরা বিভিন্ন হিন্দু সম্প্রদায়ের সুপ্রতিষ্ঠিত কেন্দ্র ছিল, চৈতন্যের উদ্যোগে এবং চৈতন্য-অনুগামীদের (গৌরগণ) চেষ্টায় জনহীন বৃন্দাবন রাধাকৃষ্ণ কাল্ট-এর সর্বভারতীয় কেন্দ্রে পরিণত হল।
সন্ন্যাসের পর চৈতন্য নীলাচলে স্থায়ী ভাবে থেকে যান। কিন্তু এটা বুঝতে তাঁর অসুবিধা হয়নি, আর্যাবর্তে স্থায়ী জায়গা না পেলে তাঁর প্রচারিত পন্থা সর্বভারতীয় স্বীকৃতি পাবে না। কাশী-মথুরায় তখন অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রবল প্রতাপ। এ দিকে বৃন্দাবনের ঐতিহ্য ছিল, কিন্তু পৌরাণিক যুগের পর ধর্মস্থান হিসেবে তেমন গুরুত্ব ছিল না। রাধাকৃষ্ণ ভজনার কেন্দ্র হিসেবে বৃন্দাবনের থেকে ভাল জায়গা আর কী হতে পারে? চৈতন্য রূপ-সনাতনকে বৃন্দাবন পাঠান ব্রজমণ্ডল উদ্ধারের জন্য। পরে পাঠান আরও অনেককেই। যেমন লোকনাথ গোস্বামী নাকি বৃন্দাবনে ৩৩৩টি বন আবিষ্কার করেন এবং রূপ-সনাতনের সাহায্যে সে সবের নামকরণ করেন। নিত্যানন্দও পাঠিয়েছিলেন অনেককে, চৈতন্যচরিতামৃত লেখক কৃষ্ণদাস কবিরাজ যাঁদের অন্যতম। রূপ-সনাতন-জীব শাস্ত্ররচনা করে, আবিষ্কৃত বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে, প্রাচীন তীর্থ খুঁজে বার করে বৃন্দাবনের আমূল রূপান্তর ঘটান।
|
|
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে অন্তত খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক পর্যন্ত মথুরামণ্ডলে বৌদ্ধ ও জৈনদের ব্যাপক প্রভাব ছিল। ১০১৮ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মামুদ যখন মথুরা লুঠ করেন, হয়তো তখনই বৃন্দাবনও ধ্বংস হয়। চৈতন্যের সময় বৃন্দাবনে কয়েকটি টিলা মাত্র ছিল। গোমা টিলার কাছেই রূপ গোস্বামী গোবিন্দ মূর্তি খুঁজে পান (১৫৩৫)। একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রোজ এক গাভী এসে দুধ দিত, সেখানেই নাকি মাটি খুঁড়ে মূর্তিটি পাওয়া যায়। খেয়াল রাখা দরকার, বাংলার বহু জায়গায় মধ্যযুগের শেষ পর্বে মন্দির স্থাপনের কাহিনির সঙ্গে এই রকম গাভীর দুধ দিয়ে যাওয়ার গল্প জড়িয়ে আছে। কুড়ি-পঁচিশ ফুট উঁচু গোমা টিলার উপরেই প্রথম গোবিন্দ মন্দির স্থাপিত হয়। সনাতন গোস্বামী মহাবন থেকে মদনমোহনকে উদ্ধার করে (১৫৩৩) দ্বাদশাদিত্য টিলায় স্থাপন করেন। এই টিলাও চল্লিশ ফুটের মতো উঁচু। এই সব টিলা যে আসলে বৌদ্ধস্তূপের ধ্বংসাবশেষ, তেমন সম্ভাবনা প্রবল, পুলিনবিহারী দত্ত তাঁর অসামান্য বৃন্দাবন কথা বইয়ে (১৩২৬ বঙ্গাব্দ) সেটা লিখেছিলেন। বিশ শতকের শেষ দিকে দ্বাদশাদিত্য টিলায় অশোকের সময়কার ব্রাহ্মীতে লেখা অনুশাসনের অংশ পাওয়া গিয়েছে। ফলে এই সব জায়গা বেছে মন্দির স্থাপনের পিছনে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করার আগ্রহ বোধহয় একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রাচীন বিগ্রহ ‘আবিষ্কার’ করে প্রতিষ্ঠা করার মধ্যেও এই মানসিকতা স্পষ্ট। বংশীবটের কাছে যমুনার তট থেকে গোপীনাথ বিগ্রহ পান সনাতনের শিক্ষাগুরু পরমানন্দ ভট্টাচার্য। জীব গোস্বামী প্রতিষ্ঠা করেন রাধাদামোদর। গোবিন্দ-মদনমোহন-গোপীনাথ-রাধাদামোদর বৃন্দাবনের চার প্রধান মন্দির, জীব-পরবর্তী পর্বে (সতেরো-আঠেরো শতকে) এই চার মন্দিরের অধিকারীরাই ব্রজের সাম্প্রদায়িক ও অর্থনৈতিক নেতা হয়ে ওঠেন।
মধ্যযুগের বৃন্দাবন পুরোপুরি গৌরগণের সৃষ্টি। ষোড়শ শতকে বৃন্দাবনে, এমনকী ব্রজের অন্যত্রও ধর্মব্যবসায়ীদের ভিড় জমেনি। তারাপদ মুখোপাধ্যায় শতকের শেষ দশকের এক ফরমান থেকে দেখিয়েছেন, তখন বৃন্দাবনের আঠেরোটা মন্দিরের মধ্যে ষোলোটাই ছিল গৌরগণের। পরে আস্তে আস্তে এই চৈতন্য-অনুগামীদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে অন্যরা এসে রূপ-সনাতনের আদর্শে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে নতুন সম্প্রদায়ের সূচনা করেন। তবে জীব বিশ্বাস করতেন, বৃন্দাবন তীর্থকেন্দ্র হলেও তাঁদের সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ গৌড়মণ্ডলে। বাংলার সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, বৃন্দাবন থেকেই বাংলায় চৈতন্যের বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন জীব গোস্বামী। গৌড়, বঙ্গ ও উৎকলে ধর্মপ্রচারের জন্য নরোত্তম, শ্রীনিবাস ও শ্যামানন্দকে পাঠিয়েছিলেন তিনি। ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে বাক্সভর্তি পুথিপত্র লুঠ হওয়ার পরেও হতাশ না হয়ে শ্রীনিবাস আচার্য যে ভাবে বীর হাম্বিরকে ‘ধর্মান্তরিত’ করে ফেলেন, তাতেই বিষ্ণুপুরকে কেন্দ্র করে বাংলায় চৈতন্য-প্রচারিত ধর্ম স্থায়ী হতে পেরেছিল। কিন্তু জীব গোস্বামীই ছিলেন শেষ শাস্ত্রকার, তাঁর সঙ্গেই শেষ হয়ে যায় বৃন্দাবনে গৌরগণের বিদ্যা-সাধনা-বৈরাগ্যের যুগ।
মুঘল রাজশক্তির আনুকূল্যে আস্তে আস্তে বৈভব বাড়তে লাগল বৃন্দাবনের। মুঘল দরবারের হিন্দু অভিজাত, বৃন্দাবনের বাঙালি বৈষ্ণবদের অখণ্ড প্রতাপ আর আকবরের কূটনৈতিক উদারতা, এই ত্র্যহস্পর্শ বৃন্দাবনের পক্ষে নিতান্ত শুভ হয়ে উঠেছিল। ১৫৬২-তে আকবরের সঙ্গে অম্বররাজ বিহারীমলের মেয়ের বিয়ে হয়, বিহারীমল পাঁচহাজারি মনসবদারি, বৃন্দাবনের জায়গির পেলেন। তাঁর সুপারিশে তিন বছর পর মদনমোহনের সেবক গোপালদাস দুশো বিঘে জমি পান। তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, মুঘল দরবারের সঙ্গে বৃন্দাবনের যোগাযোগ সেই প্রথম, বৃন্দাবনের মন্দিরের ভূসম্পত্তি সেই প্রথম, আর হিন্দু দেবতার ভরণপোষণের জন্য মুসলমান সম্রাটের দানও ভারতের ইতিহাসে সেই প্রথম।
বৃন্দাবনের পরবর্তী জায়গিরদার হন টোডরমল। ১৫৯০-এ জীব গোস্বামীর হয়ে টোডরমল আকবরের কাছে আবেদন জানান, গোবিন্দ ও মদনমোহন মন্দিরের সেবকদের আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হোক। আসলে মোগল বাদশাহরা বৃন্দাবনের গৌড়ীয় মন্দিরে বিপুল ধনসম্পত্তি দিয়েছিলেন বলেই সেবাধ্যক্ষের পদে সম্রাটের অনুমোদন দরকার ছিল। বৃন্দাবনে লাল পাথরের গোবিন্দ, গোপীনাথ আর যুগলকিশোর মন্দির আকবরের রাজত্বকালে রাজপুত রাজাদেরই তৈরি। আকবরের আগে ফতেপুর সিক্রির লাল পাথর দিয়ে মন্দির তৈরির অনুমতি পাওয়া সম্ভব ছিল বলে মনে হয় না। মদনমোহনের দ্বিতীয় মন্দিরটি বাঙালি গুণানন্দের তৈরি। বসন্ত রায়ের অর্থেই সম্ভবত তাঁর বাবা গুণানন্দ মদনমোহন মন্দির তৈরি করেন। বসন্ত রায় ছিলেন প্রতাপাদিত্যের কাকা। আকবর নাকি বাঙালি বৈষ্ণবদের দেখে বৃন্দাবনের নাম পালটে ‘ফকিরাবাদ’ রেখেছিলেন। তিনি ফরমান দেন, বৃন্দাবনে মৃগয়া করা যাবে না, গাছও কাটা যাবে না। ১৫৯৮-এ আকবরের নির্দেশে ব্রজের মন্দিরগুলির আর্থিক অবস্থা খতিয়ে দেখতে আবুল ফজলের নেতৃত্বে কমিটি হয়, অন্য দুই সদস্য হিন্দু। কমিটির সুপারিশে ব্রজের ৩৫টি মন্দিরের (অধিকাংশই গৌরগণের) সম্পত্তি দাঁড়ায় হাজার বিঘে!
বৃন্দাবনের সৌভাগ্যসূর্য অস্ত গেল আওরঙ্গজেবের সময়। আওরঙ্গজেবের ফৌজদার মথুরা ধ্বংস করেন ১৬৬৯-এ, বৃন্দাবন ১৬৭০-এ। আওরঙ্গজেব নাকি বৃন্দাবনের নাম রাখেন ‘মুমিনাবাদ’ (ইসলামে বিশ্বাসীদের বাসস্থান)। কিন্তু আগে থেকেই খবর পেয়ে মথুরা-বৃন্দাবনের অধিকাংশ বিগ্রহ নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে ফেলা হয়। মূলত রাজপুত রাজারাই বিগ্রহ এবং তার সেবকদের আশ্রয় দেন। যেমন মথুরার কেশবদেবকে নাথদ্বারে নাথজি নামে প্রতিষ্ঠা করা হয়, গোবিন্দজিকে প্রথমে কাম্যবনে, পরে অম্বরে আনা হয়। বাঙালি গোস্বামীরা একমাত্র জয়পুর রাজের আশ্রয় নেন, আর এই ভাবেই জয়পুরে বাঙালি উপনিবেশের সূচনা হয়। তবে ধ্বংসের উন্মত্ততা কেটে যাওয়ার পর, বিগ্রহ স্থানান্তরিত হলেও বৃন্দাবন জনশূন্য হয়ে যায়নি। জয়পুর রাজ সওয়াই জয়সিংহ মহম্মদ শাহের আমলে মথুরামণ্ডলের শাসনভার পান (১৭২১-’২৮)। তিনি রাজধানী সরিয়ে আনেন জয়পুরে, তৈরি করে দেন গোবিন্দজির নতুন মন্দির। সেখানেও সেবক কিন্তু সেই বাঙালিরাই। পুলিনবিহারী দত্ত বাঘনাপাড়ার গোস্বামীবংশের বিপিনবিহারী গোস্বামীকে উদ্ধৃত করে তাঁর বইয়ে একটি গল্প লিখেছেন। গোবিন্দ মন্দিরে রাধাকৃষ্ণকে একাসনে পুজো করা নিয়েই বিরোধের সূচনা। শ্রী, রামানন্দী ইত্যাদি বৈষ্ণব সম্প্রদায় রাধাকে পুজো করার বিরোধী, কারণ কোনও প্রামাণিক শাস্ত্রগ্রন্থে রাধার উল্লেখ নেই। শ্রী সম্প্রদায়ের বৈষ্ণবরা সওয়াই জয়সিংহকে তাঁদের আপত্তির কথা জানান, বাঙালি সেবকরা সদুত্তর দিতে না পারায় রাধার আলাদা পুজোর ব্যবস্থা হয়, কৃষ্ণের আগে পুজো শুরু হয় শালগ্রামশিলার, কর্মচ্যুত হন বাঙালিরা।
বৃন্দাবনে হায় হায় পড়ে গেল, এ বার বোধহয় গৌড়ীয়দের পাট চুকল। শেষে গোবর্ধন পাহাড়ের গুহা থেকে বলদেব বিদ্যাভূষণকে (গোবিন্দদাস) ডেকে এনে জয়পুর পাঠানো হল, তিনি শ্রী বৈষ্ণবদের তর্কে হারিয়ে বাঙালির হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করেন, রাধাও সসম্মানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হন। তবে পরিস্থিতি অনুকূল হলেও কোনও প্রাচীন বিগ্রহকেই আর বৃন্দাবনে ফেরত পাঠানো হয়নি, আস্তে আস্তে স্থাপন করা হয় প্রতিভূ-বিগ্রহ। আজও সেই সব প্রতিভূ-বিগ্রহেরই পুজো হয় বৃন্দাবনে।
|
|
বিগ্রহ যা-ই থাকুক, ১৮০৩-এ মথুরা অঞ্চল ব্রিটিশ অধিকারে আসার পর থেকে আবার বৃন্দাবনে মন্দির-বাড়ি ঘর তৈরির জোয়ার এল। উনিশ শতক জুড়ে অন্য প্রদেশের মানুষের সঙ্গে বহু বাঙালি অভিজাত পরিবার বৃন্দাবনে শুধু যে মন্দির বানিয়ে দিয়েছেন তাই নয়, বসবাসও করেছেন। সে তালিকায় একেবারে শুরুর নাম শুধু নয়, অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নামও বোধহয় দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দের নাতি কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ। কান্দি-পাইকপাড়া রাজপরিবারের এই মানুষটি ‘লালাবাবু’ নামেই বিখ্যাত ছিলেন। এক রজককন্যার মুখে ‘বেলা যে পড়ে এল, বাস্নায় আগুন দাও’ কথাটি শুনে সত্যিই তাঁর বৈরাগ্য এসেছিল কিনা কে জানে, তবে বৃন্দাবনে চলে গিয়ে মন্দির তৈরি করে তিনি সেখানেই জীবন কাটান (১৮৪২-এ মৃত্যু)। মন্দিরের সেবাপুজোর জন্য বিপুল জমিদারির ব্যবস্থাও করেন, আজও সে সেবা চালু আছে। শেষ পর্বে তিনি মাধুকরী নিয়েছিলেন। কিন্তু লালাবাবুর মন্দিরের মতো বাঙালির সব কীর্তি আজ আর অটুট নেই। চব্বিশ পরগনার বহড়ুর জমিদার দেওয়ান নন্দকুমার বসু জয়পুররাজের অনুমতি নিয়ে বৃন্দাবনের তিন প্রধান বিগ্রহের (গোবিন্দ-গোপীনাথ-মদনমোহন) জন্য তিন-তিনটি নতুন মন্দির তৈরি করে দেন (১৮১৯-’২১)। পরবর্তী সংযোজনের ঠেলায় নন্দকুমারের মন্দিরগুলির আদি রূপ আজ আর বোঝা সম্ভব নয়, তাঁর নামও কেউ মনে রাখেনি। অথচ ১৩৩৩ বঙ্গাব্দেও জ্ঞানেন্দ্রনাথ কুমার বংশপরিচয় ৫ম খণ্ডে লিখছেন, ‘তাঁহার প্রাতঃস্মরণীয় নাম এ পর্য্যন্ত বৃন্দাবন অঞ্চলে ও এতদ্দেশে অতি ভক্তি ও শ্রদ্ধার সহিত উচ্চারিত হইয়া থাকে।’ আরও দুঃখের কথা, নন্দকুমার নিজে পাথরের এক কুঞ্জবাটি তৈরি করে রাধাগোবিন্দ স্থাপন করেন, যমুনায় বিসর্জন দেওয়ার আগে অস্থি নিয়ে এখানে লোকে বিশ্রাম করত বলে নাকি এর নাম হয়ে যায় হাড়াবাড়ি কুঞ্জ, সেটি কিছুদিন হল বিক্রি হয়ে গিয়েছে। এ ভাবেই বিক্রি হয়ে গিয়েছে হেতমপুরের রাজা রামরঞ্জন চক্রবর্তীর তৈরি অষ্টসখী মন্দির, ১২৯৬ বঙ্গাব্দে যেখানে তিনি রাধারাসবিহারী বিগ্রহ স্থাপন করেছিলেন। সেখানে এখন বহুতল মন্দির তৈরি হয়েছে, উপরে শুধু টিকে আছে মূল মন্দিরের চূড়া। বর্ধমানের রানি রাজরাজেশ্বরীর মন্দির, কাশিমবাজারের মহারানি স্বর্ণময়ীর মন্দির, পাবনার তাড়াশের জমিদারদের ঠাকুরবাড়ি, গুরুপ্রসাদ বসু বা ‘কালাবাবু’র কুঞ্জ আজ খুঁজে বার করাই কঠিন, হারিয়ে গিয়েছে বহু নাম। শোভাবাজারের রাজা রাধাকান্ত দেব জীবনের শেষ তিন বছর (১৮৬৪-’৬৭) বৃন্দাবনে কাটান, তিনি এই অঞ্চলে জীবহত্যা বন্ধ করার ব্যবস্থা করেন। সে কথা মথুরা থেকে বৃন্দাবন যাওয়ার পথে বালাবাইয়ের সেতুর গায়ে তিন ভাষার লিপিতে খোদাই করা ছিল, আজ কে তার খোঁজ রাখে।
শুধু বিখ্যাত মন্দির নয়, আঠেরো-উনিশ শতক জুড়ে বৃন্দাবনে লাল পাথরের অজস্র বাড়িঘর, তার সঙ্গে ছোটবড় মন্দির তৈরি হয়েছে। ১৯১৯-এ পুলিনবিহারী দত্ত লিখছেন, বৃন্দাবনের পথ অপ্রশস্ত ও আঁকাবাঁকা, তবে ইট বা পাথর বসানো, তাই বর্ষায় কলকাতার মতো কাদা হয় না। অধিকাংশ বাড়ি একতলা, দোতলা-তিনতলা খুব কম। অধিকাংশ বাড়িতেই দেবমূর্তি, অন্তত শালগ্রাম ও তুলসীমঞ্চ আছে, তাই বাড়িগুলিকে ‘কুঞ্জ’ বলে। বাড়ির প্রবেশপথ কারুকার্যখচিত পাথরের খিলানে শোভিত। বাড়ির গাঁথনি ছোট ছোট ইটের, দেওয়ালে বালির পলেস্তারার বদলে পাথরের ফলক বসানো। বাড়ির ছাদে পাথরের কড়ি, আর টালির বদলে বড় বড় পাথরের ফলক। খুব সাধারণ বাড়ির দেওয়ালেও ছিল চমৎকার কারুকার্য। আজ অধিকাংশই হাত বদল বা জবরদখল হয়ে গিয়েছে, বদলে যাচ্ছে চেহারা, যেটুকু টিকে আছে তার দিকে কারও নজর নেই। প্রোমোটারের থাবা সর্বত্র, পুরনো হাভেলি ভেঙে হোটেল কি বাড়ি তৈরি হচ্ছে, বৃন্দাবনে এসে ‘শান্তিতে’ থাকতে চাইলে বাড়ি বা ফ্ল্যাটের অভাব হবে না। গোবিন্দ, মদনমোহন, যুগলকিশোর, রাধাবল্লভ ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণের সংরক্ষণের আওতায় আছে। কিন্তু গোপীনাথের সেবকরা সর্বেক্ষণকে মন্দির দিতে রাজি হননি, তাঁরা এখন ফেংশুই করে মন্দির রক্ষা করতে চাইছেন! অর্থাৎ ইচ্ছেমতো অদলবদল চলছেই। বৃন্দাবন পরিক্রমায় এখন পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাওয়াই কঠিন, কংক্রিটের তলায় হারিয়ে গিয়েছে ব্রজরজঃ। গৌড়ীয় গোস্বামীদের ‘সমাজ’ বা সমাধি ছিল বাংলা চালার আকৃতিতে, আজ তার অন্য রূপ। লালাবাবু থেকে কালাবাবু, দীর্ঘ এই তালিকার অস্তিত্ব আজ প্রায় সবটাই বইয়ের পাতায়।
ভক্তদের কাছে তো বৃন্দাবন তীর্থ, তার বাড়িঘর, কারুকার্য, স্মৃতিধার্য নয় তাঁদের কাছে। হেরিটেজ সন্ধানী পর্যটকদের কেন পা পড়বে না বৃন্দাবনে, হারিয়ে যাওয়া হাভেলি আর পুরনো মন্দিরের গর্ভগৃহে-নাটমন্দিরে তাঁরা কেন খুঁজবেন না ইতিহাস? তাঁদের ডেকে আনার ব্যবস্থা কেন করা হবে না? কেন কেশীঘাটের পাথর ভেঙে ফেলে কংক্রিট ঢালাই করে যমুনা-আরতির জায়গা করা হবে, আরতির ঔজ্জ্বল্যে ঢাকা পড়ে থাকবে বিনষ্ট ঐতিহ্যের অবশেষ?
|
ছবি: অভিমন্যু দত্ত |
|
|
|
|
|