|
|
|
|
|
বার্নিং ম্যান ফেস্টিভাল |
ব্ল্যাক রক ডেজার্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডা প্রদেশের ধু ধু মরুভূমি। জনপ্রাণী থাকে না সেখানে। সেটাই প্রতি বছর, অগস্ট মাসের শেষ সোমবার থেকে একটা বিশেষ গোষ্ঠীর যা প্রাণে চায়, তাই করার ইচ্ছে-ভূমি হয়ে যায়। এক সপ্তাহের জন্য। তারই নাম বার্নিং ম্যান ফেস্টিভাল।
এই ফেস্টিভাল’টা শুরুর সময় একটা কাঠের মানুষকে দাউদাউ করে পোড়ানো হয়েছিল। এমন রেওয়াজ তো অনেক দেশেই আছে। যেমন আমাদের দেশের হোলিকা দহন, দশেরা। তার সঙ্গে থাকে গল্পও। তা, বার্নিং ম্যান-এর এই আগুনের মানে কী? ওঁরা বলেন, নিজেকে যেমন খুশি প্রকাশ করব আমি, যা প্রাণে চায় করব এই ভাবনাটাকে কোনও কাজের মধ্য দিয়ে সবাইকে জানাতে চেয়েছিলেন। তারই মাধ্যম হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন এই আগুনকে। উৎসবটাকে একটু মন দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলে কাণ্ডটার একটা ব্যাখ্যা হয়তো পাওয়া যায়। এ যেন সমাজের নিয়ম-কানুন মেনে গড়ে ওঠা আমিটাকেই পুড়িয়ে শেষ করে ফেলা। এ বার সামনের সাত দিন, একেবারে অন্য আমি, নিজের মর্জিমতো বাঁচব, এই কৃত্রিম শহরে। ‘অন্য’ সমাজে।
সেই অন্য সমাজকে রোজকার পৃথিবী হয়তো বলবে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা। সৃষ্টিশীল মানুষের মনের মধ্যে এমন অনেক সাধ ইচ্ছেই থাকে, যেগুলোকে এই চেনা সমাজ বিশৃঙ্খল, নিষিদ্ধ, অশালীন ইত্যাদি শব্দ দিয়ে দাগায়। অথচ সেই মানুষটাকে ওই ইচ্ছেগুলো পূরণের স্বাধীনতা দিলে, তিনি হয়তো সৃষ্টির দুনিয়ায় নিজের সেরাটা উজাড় করে দিতে পারেন। সেই পরিবেশই তৈরির চেষ্টা করা হয় ব্ল্যাক রক সিটিতে।
যেমন ধরুন, একটি যুবতী মেয়ে। গায়ে শুধু রং মেখে ঘুরছে। পোশাক নেই বলে তার লজ্জা নেই, কেউ দুয়োও দিচ্ছে না। আবার কেউ হয়তো কয়েকটা ট্রাকগাড়ি সাজিয়েই বানিয়ে ফেলল একটা মস্ত ড্র্যাগন। ব্ল্যাক রক সিটির অস্থায়ী শিল্প-শিবিরে, গ্যালারিতে, অডিটোরিয়াম-এ এরকমই স্বাধীনতা উদ্যাপনের অজস্র দৃষ্টান্ত মেলে।
বার্নিং ম্যান কিন্তু কতগুলো নিজস্ব কানুন মেনে চলে। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের মানুষ এই ইচ্ছেপূরণ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারে। এখানে উপহার প্রথা চলে। কিন্তু কোনও প্রতি-উপহারের প্রত্যাশা রাখা চলবে না। হয়তো কাউকে আপনি একটা গাড়িই দিয়ে ফেললেন, সে আপনাকে কিচ্ছু দিল না, কিম্বা হয়তো একটা টফি দিল বড়জোর। আপনি দুঃখ পেতে পারবেন না। ওখানে গোটা অর্থনীতিই দাঁড়িয়ে আছে এই উপহার-প্রথার ওপর। টাকাপয়সার লেনদেন হয় না, কোনও স্পনসরশিপ নেন না ওঁরা, পণ্য শব্দটাই বার্নিং ম্যান-এর অভিধানের বাইরে। শুধু কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী ‘বিক্রি’ হতে পারবে। যেমন চা, কফি, লেমনেড, বাসের টিকিট, প্রবেশাধিকারের ছাপ্পা মারা রিস্টব্যান্ড ইত্যাদি।
ফেরার সময়, এঁরা প্রকৃতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিয়ে যান। ওঁরা যে এসেছিলেন, কিছু যে হয়েছিল, তার কোনও চিহ্ন, কোনও আবর্জনা পড়ে থাকবে না। স্বাধীনতা চাই? তবে তার ভার বইবার, দায়িত্ব নেওয়ার খাঁচাটাও তো চাই!
অনেক পড়াশোনা, গবেষণা হচ্ছে এই ‘অন্য সমাজ’কে ঘিরে। এ রকম ইউটোপিয়া-দুনিয়া, যেখানে নিয়মের বাঁধন নেই, যেখানে ব্যক্তিগত ইচ্ছেদের শাসন করে না কেউ, যেখানে মানুষ মানুষকে যখন তখন উপহার দেয়, প্রশংসা করে তার সব রকমের ইচ্ছেদের, ইচ্ছেগুলোর উন্মুক্ত প্রকাশকে, তার উৎসবকে, সেই পৃথিবীটা কি সত্যিই বানানো সম্ভব?
আর যদি বানানো যায়ও, সেখানেই কি মানুষরা বেশি ভাল থাকে? সেখানেই কি শিল্প, সংস্কৃতি বেশি স্বচ্ছন্দ? জানতে গেলে চাক্ষুষ দেখতে হবে ওই আগুন-মানুষদের! |
|
|
|
|
|