|
|
|
|
লক্ষ্য তারও রমণীর মন |
সেই কাঙ্ক্ষিতের সাধনাতেই তো ময়ূর-পুরুষ ছড়িয়ে দেয় তার সহস্রধার সৌন্দর্য।
কৃষ্ণের কেশচূড়ায় শিখিপাখা তাই দিগ্বিজয়ী প্রেমের স্বাক্ষর। চিরদীপ উপাধ্যায় |
ছোটবেলায় বাড়িতে একটা তিনতলা কাঠের শেলফ ছিল। সেখানে ঠাকুরদেবতারা বসত করতেন। বেশির ভাগই ফ্রেমে আঁটা ছবি, দু’চারখানা মূর্তিও ছিল সঙ্গে। দশ ফুট বাই দশ ফুটে ওটাই ঠাকুরঘর। এখনও সেই শেলফটা আছে, ছোটবেলার বাড়িতে যখন যাই, মাঝে মাঝেই এক ঝলক দেখে নিই। এবং, ঠিক ছোটবেলার মতোই, আজও প্রথম চোখে পড়ে শিখিপাখাটি। রাধাকৃষ্ণের একটা ছবি। বয়েস অন্তত ষাট। মাঝে দু’এক বার ফ্রেম আর কাচ পালটানো হয়েছে ঠাকুমার আঙুলের ছাপ চলে গেছে পুরনো কাচের সঙ্গে, মায়ের হাতের ছাপ এসেছে, আবার নতুন কাচ এসে তাকেও নিয়ে চলে গেছে। সময়ের পলি জমে জমে ছবির রংও পালটেছে নিশ্চয়ই। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছোটবেলার ভাল-লাগার রংও বিবর্ণ হয়েছে, উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বলতে শিখেছি, ‘ক্যালেন্ডার আর্ট!’ কিন্তু কী জানি, এই সায়াহ্নেও বেশ লাগে সে ছবি দেখতে। হাতে মোহনবাঁশি, মুখে মিষ্টি এবং, অবশ্যই, দুষ্টু হাসি, চূড়াটি ঈষৎ হেলানো, অবশ্যই বামে, ত্রিভঙ্গমুরারীর মাথায় চূড়ো, আর সেই নীল-অঞ্জন-ঘন-পুঞ্জিত কেশদামে শোভা পায় একটি নীল ময়ূরপুচ্ছ, মাঝখানে সাদা ‘চোখ’। তার নীলিমা যেন এখনও তেমনই উজ্জ্বল, যেন স্বপ্নে দেখা নীল যমুনা, কিংবা মাসকাবারির থলিতে দেখা রবিন ব্লু। শিখিপাখা ছাড়া কৃষ্ণকে ভাবতে পারি না। আজও।
পদকর্তারাই কি ভাবতে পারতেন? বৈষ্ণবপদাবলির আনাচেকানাচে কত ময়ূর যে তাদের পেখম মেলে সঞ্চরণ করে চলে, তার হিসেব কে রাখে? শ্রীগীতগোবিন্দের জয়দেব ‘চন্দ্রকচারুময়ূরকমণ্ডলবলয়িতকেশম্’, মানে, কেশদাম অর্ধচন্দ্রাকারে সুন্দর ময়ূরপুচ্ছে বেষ্টিত থাকায় যিনি বিশাল, সেই ‘শ্রীকৃষ্ণের রাসোচিত রূপ’ বর্ণনায় বিভোর।
আবার দ্বিজ চণ্ডীদাস লিখছেন,
একাকিনী রাধা ‘হসিত বয়ানে
চাহে চন্দ্র পানে
কি কহে দু হাত তুলি’
এবং তার পরেই অনিবার্য ভাবে
‘একদিঠি করি
ময়ূর ময়ূরী
কণ্ঠ করে নিরীক্ষণে।’
সেই বিরহিণীকেই সখী এসে বলে, ‘সজনি, কি হেরিনু যমুনার কূলে’,
এবং ব্রজ-কুল-নন্দনের রূপগুণের বিবরণ দেয়
‘বাঁশী কেন বলে রাধা রাধা’ বলে শ্রীমতীর মনযমুনায় ভাবতরঙ্গ তোলে,
তখনও বলতে ভোলে না, ‘মল্লিকা-চম্পক-দামে
চূড়ার টালনী বামে
তাহে শোভে ময়ূরের পাখ।’ |
|
রাধাকৃষ্ণের কাহিনিতে কোথা থেকে এল এই পাখিটি, কী ভাবে তার পাখা স্থান পেল কৃষ্ণের চূড়ায়? কাহিনি বলে, বৃন্দাবনবিহারী উদ্যোগ করে তাঁর শিখিপাখাটি সংগ্রহ করেননি, ময়ূর সেটি নিজেই তাঁকে দিয়েছিল। ভালবেসে। বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে। কৃষ্ণ কেমন গোপীমোহন নন, পশুপাখির মনও তিনি হরণ করেছিলেন তাঁর বাঁশির তানে, তাঁর নাচের ছন্দে, তাঁর স্বভাবের মাধুর্যে। এবং অবশ্যই তাঁর অমিত আশ্রয়ে গিরিগোবর্ধনের নীচে তো কোনও প্রাণীই অবাঞ্ছিত ছিল না! তাই ময়ূর তার সৌন্দর্যের একটি কণা যদি উপহার দেয়, সে তো অতি সামান্য উপহার।
অসামান্যও। শিখিপাখা বললেই মনে আসে সেই আশ্চর্য অপার্থিব দৃশ্য। গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা তখনও নামেনি, যমুনার কূলে ময়ূর তার পেখম মেলেছে। সেই দৃশ্য দেখে কৃষ্ণ মুগ্ধ হবেন না? সেই দৃশ্যের একটি শলাকা নিজের কেশবন্ধে সংযোজন করতে প্রলুব্ধ হবেন না?
এহ বাহ্য, আগে কহ আর। শ্রীকৃষ্ণের তো অজানা নয় যে, ওই সহস্রধার দেহবিভঙ্গে যে বিহঙ্গটি নিজেকে মেলে ধরেছে, সে এক পুরুষ। প্রকৃতির নিয়মে, ডারউইনের ভাষায় বললে উদ্বর্তনের নিয়মে পুরুষ ময়ূর তার পেখম মেলে নারীকে আকর্ষণ করে, ওই সৌন্দর্য তার জীবনধারাকে প্রবাহিত রাখার উপায়মাত্র। এই তত্ত্বের ঠিক-ভুল নিয়ে নাকি বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ আছে, কোথাও কোথাও তাঁরা নাকি গবেষণা করে দেখেছেন, ময়ূর নাচে ময়ূরীকে আকর্ষণের জন্য নয় ময়ূরী অমন জবড়জং দেহসঞ্চালন দেখে মোটেই আকৃষ্ট হয় না ওই ভাবে নাকি ময়ূর তার প্রতিদ্বন্দ্বী পুরুষকে সন্ত্রস্ত এবং প্রতিহত করে। হবেও বা, ময়ূর হলে কী হবে, পুরুষ তো, লড়াই বিনা গীত নাই! তা, মন ভোলানো হোক আর যুদ্ধং দেহি হোক, লক্ষ্য তো সেই এক: রমণীর মন।
কৃষ্ণেরও ওই এক টার্গেট। ফলে, এই পাখিটির দেওয়া একটি পাখা তিনি নিজের মাথায় ধারণ করবেন, সে আর বিচিত্র কী? আর, সেই শিখিপাখাটি দেখে রাধারও কি মনে একটা বাড়তি পুলক জাগে না? মনে কি হয় না তাঁর সমস্ত গোপবালা যার প্রতি অনুরক্ত, সে আমার মন চায়? নিজেকে গরবিনী লাগে না? ওই গর্বেই রাধার মরণ, জানি। রাধাও জানেন। |
|
|
|
|
|