|
|
|
|
কী হেরিনু যমুনার কূলে |
রাধাকৃষ্ণের লীলাসঙ্গিনী। অন্য নাম কালিন্দী। জন্মাষ্টমীর নবজাতককে পথ করে
দিয়েছিল এই নদী। ওই জাতকের টানেই তো তার মর্তে অবতরণ। অমিতাভ মালাকার |
যৌবনে পদার্পণের পরও বেশ কিছু কাল ফালতু হাঁটাহাঁটিতে নির্বিকার কাটছে, এমতাবস্থায় পকেটে প্রথম চাকরির চিঠি আর ডালাভাঙা তোরঙ্গে পেল্লায় তালা ঝুলিয়ে পৌঁছলাম দিল্লি, রোজগার করতে হবে। আপিসে যাইনে বিশেষ, তার মধ্যেই নিস্তেজ বর্ষার ঝিম মারা দুপুরে বেকায়দায় পেয়ে সায়েব খপ করে পাকড়ে বললে, ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে না বেরিয়ে বৃন্দাবনে যমুনাতীরে কুঞ্জবন-টন দেখে দিনকতক তমালছায়ে কাটিয়ে এসো বরং, আপিসে ঘুরঘুর করে বেড়ানোটা ম্যানেজমেন্ট ভাল চোখে দেখে না।
বোষ্টম বাড়ির ছেলে, একছুটে ক্যালেন্ডারে নাক ঠেকিয়ে হিসেব কষতে বসলাম, কবে শ্রাবণ পুন্নিমে আর জন্মাষ্টমী। বৃন্দাবনে পা দিয়েছি কী দিইনি, সঙ্গীরা ফেলে পালালে। শহর ভিড়ে বেসামাল, দু’দণ্ড বসে ভগবৎ-চিন্তায় নিজেকে বিলীন-টিলিন করব, তেমন ভাবনার অবকাশটুকুও পুণ্যার্জনে অতিতৎপরদের কনুইয়ের গুঁতোয় অসম্ভব মনে হল। নাজেহাল হয়ে এক টাঙ্গা চালকের লুঙ্গির খুঁট ধরে ঝুলে পড়লাম। সে অমনি গাড়ি হাঁকিয়ে সোজা যমুনা কে পার। তমাল চিনি না, ঘাসজমির ওপর দিয়ে একটু হেঁটে যেমন তেমন ঘন পাতাওয়ালা এক গাছের ছায়ায় বসলাম। একটু নীচে ধ্বসে পড়া মাটি, মানুষের পায়ের চাপে ছোট নৌকা ভিড়িয়ে পারাপারের ঘাটে রূপান্তরিত হয়েছে। নারী-পুরুষ ক’জন এক পাশে সাদা কাপড়ে মোড়া একটি মৃতদেহ নিয়ে বসে আছে। কাঁদছে না কেউ তেমন হাত-পা ছুঁড়ে। হয়তো পশ্চিমের এ দিকটায় উচ্ছ্বাস কম, এমনকী মৃত্যুর আঘাতেও!
পুরাণ অনুযায়ী এ নদী মা গঙ্গার মতোই মানব আত্মাকে শুদ্ধ, পবিত্র বা দার্শনিক চিন্তাভাবনায় উদ্বুদ্ধ করবার বদলে নেমে এসেছিল মর্তলোকের সব পাপ ধুয়ে-মুছে এমনকী যমের হাত থেকেও মানুষকে বাঁচাতে। লোকগাথায়, গানে, নৌটঙ্কিতে যমের অত্যন্ত আদরের যমজ বোন যমীর গল্প আছে। যমী আসলে কৃষ্ণকে সঙ্গী রূপে বেছে নিয়ে তাঁর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্যই ধরায় অবতীর্ণ হন। সেই যমীই নামান্তরে যমুনা। দু’ফাঁক হয়ে তিনি পথ করে দিয়েছিলেন চুবড়িতে শিশু কৃষ্ণকে বয়ে বসুদেব যাতে ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ তরঙ্গরাশি অতিক্রম করে অন্য পাড়ে পৌঁছতে পারেন। মৃত্যুকে পিছে ফেলে যাওয়ার গল্প মোজেস-এর এক্সোডাস-এর মতোই, নতুন জীবন তৈরির, রক্তমাংসের শরীর আঁকড়ে মৃত্যুকে উপেক্ষার কাহিনি। যমুনার চলা শুরু হয়েছিল সময়ের সূচনারও আগে, সময় থেমে যাওয়ার পরেও তার চলা থামবে না। এই খণ্ড-অনন্তের স্রোত কখনও কোনও চেনা বাঁকের মুখে নশ্বর জীবনগুলোর সঙ্গে আলাপ জমায়। ছুঁয়ে দেখতে দেয় তার আদরে-আবেশে স্ফীত শরীর। যাতে বান, খরা, রাষ্ট্রবিপ্লবে আর শেষমেশ মত্যুর অনিবার্যতায় হাঁসফাঁস করে ওঠা প্রাণগুলো অনিঃশেষের, অনন্তের স্বাদ অঞ্জলি ভরে চাখতে পায়। যমীর স্পর্শে এই ভাবেই আমরা মৃত্যুকে অতিক্রম করি তা হলে? |
|
ছবি: লেখক। |
যমুনার জল কালো কেন? যমীর মা সংজ্ঞা সূর্যের সঙ্গে মিলনকালে প্রচণ্ড তেজ সহ্য করতে না পেরে চোখ বন্ধ করে ফেলার জন্য যম-যমীর এমন ছায়াবর্ণ হল? না কি, কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের জন্যই অমন রং? ওই দুই কিসসার আশেপাশেই ঘোরাফেরা লোকবিশ্বাসের। এখানে পুরনো আমল থেকে জীবন চলছে একটানা, এই নদীর মতোই। তাই কোন ঘাটে গোপিনীরা জলকেলি করতেন আর কোথায় কেষ্ট ঠাকুরটি বাঁশি বাজিয়ে বেড়াতেন, সে সব বাপু পরিষ্কার। সারা দিন লোকজনের পারাপার দেখলাম। মাঝে এক জন ইংরেজ টাইপের বাঙালি এসে বার দশেক ‘পলিউটেড, এক্সট্রিমলি পলিউটেড’ বলে ঘাড় নেড়ে গেলেন।
সন্ধে নামল। পাশে বসে মালা জপছিলেন এক বৃদ্ধা। দূর থেকে কাঁসরঘণ্টার আওয়াজ পেয়ে দু’জনেই এক সঙ্গে ঘাড় ফেরাই। আমার দিকে চান উনি। অমন শূন্যতা মাখা চোখে না চাইলেই পারতেন। সে শূন্যতার মধ্যে কারও ডাক আসার অপেক্ষা ছিল যেন। যাদের ডাক দিয়ে যাবার কথা ছিল, তারা কি এঁকে ভুলেছে? এঁর শৈশবের আদর মেখে যাদের চোখ আবেশে বুজে আসত, হয়তো তারা গত হয়েছে বহু কাল। কিন্তু এঁর যৌবনের ছোঁয়া বুকে নিয়ে কেউ কি সত্যিই ডেকে নেওয়ার নেই আর? আমি ওঁর পুঁটলিটা তুলে নিলাম।
কতটুকুই বা সময় পেরিয়েছে, শ্রীরাধিকার এমনই আঁধারে এই পথ ধরে নিঃশব্দ পায়ে জলের আওয়াজটুকু সম্বল করে বৃদ্ধা যে গাছতলায় বসেছিলেন, সেখানে গিয়ে চুপিসাড়ে দাঁড়ানো আর আজকে আমাদের এই উঠে আসার মাঝে? পরনের থান টেনে কোনও মতে গোছানো আলগোছ ঘোমটায় বৃদ্ধার মাথা যে ধুলায় ধূসরিত উল্টোপাল্টা বাতাসে ওড়া সে ধুলো সেই বিদ্যুৎ-সচকিত রাতে শ্রীরাধিকার পায়েও জমেছিল। নিলাজ শরীরেও। সেই ধুলাই তো উড়ে বেড়াচ্ছে আজ এই শ্রাবণ পূর্ণিমার রাতে। যে কন্টিকারির ঝোপে বৃদ্ধার আঁচল সত্যিই বাঁধল আজ, বুকে সে কাঁটার দোহাই নিয়ে কি শ্রীমতী সত্যিই ফেরার পথে নানা কূট প্রশ্নের সরল উত্তর তৈরি করেননি? গিয়েছিলি তো জল আনতে বউ, বুক দিয়ে যমুনাপাড়ে হাল টানতে তো নয়? ভাই জিজ্ঞেস করলে কী উত্তর দেবেন, এক দণ্ডের তরে হলেও সে নিয়ে নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন। বৃদ্ধা রাস্তার পাশেই বসলেন এক বার। তবে কি এই পথটুকু ধরে যাতায়াতেই সুখ, এই পথটুকু পুনঃ পুনঃ পরিক্রমায় মিলন আর বিচ্ছেদের সেই অতি প্রাচীন কাহিনি নিজের শরীর দিয়ে বার বার বলে যাওয়া, সেই জীবনগুলোর এনঅ্যাক্টমেন্ট কেবল, সব রকম আত্মার সম্পূর্ণ বিসর্জনে কৃষ্ণেন্দ্রিয়প্রীতি ইচ্ছা-সুখের চরমতম অভিনয়? তার মানে তো ডাক আসার অপেক্ষায় এ চোখে অমন গভীর শূন্যতা জন্মায়নি। আমি যে কেবল তল্পিবাহক মাত্র, মেনে নিলাম সে সত্যটুকু। তার পর দু’জনে পা বাড়ালাম যে দিক থেকে আওয়াজ আসছিল, সে দিকে। উনি ফিরবেন জানি আবার সময় হলে, তেমন ঘন-কৃষ্ণ আঁধার নামলে যমুনা আকাশে পুঞ্জীভূত মেঘের সঙ্গে, ব্রহ্মাণ্ডের প্রতি কণা অণু-পরমাণু অদ্ভুত এক রহস্যাবৃত রতিক্রীড়ায় মেতে উঠলে তবেই। আমার জীবনকে রক্ষা করতে ফিরে ফিরে আসবে না এই মঙ্গলাচরণ। তবে এই বৃদ্ধাকে যেমন টেনেছিল, তেমনই ওঁর পর আবার অন্য কাউকে সেই রহস্যাবৃত, গুপ্ত রতিক্রীড়ার কাহিনি ছায়া দেবে আজীবন, টেনে নেবে ঠিক। তার পর আর এক জন আসবে, ফিরে ফিরে এসে জলের আওয়াজ ধরে অন্ধকারে হোঁচট খেয়ে ওই ধুলোয় গড়িয়ে পড়ার জন্য। ব্যস ওইটুকুই, আর কিছু নয়। |
|
|
|
|
|