|
|
|
|
|
|
রেনি ডে ও জগা’স খিচুড়ি
গগনে গরজে মেঘ গুড়গুড়, জিভ লকলক মন সুড়সুড়। অফিস
গোল্লায়, পাতে
খিচুড়ি। বাঙালি চালে-ডালে এক। রকমারি ভাজা’র সঙ্গতে
জমিয়ে রেনি ডে।
খিচু খিচু অভ্যেস, সত্যি এক রয়ে যায়... অঞ্জন চট্টোপাধ্যায় |
|
শ্যামপুকুর স্ট্রিট যেখানে এসে ভূপেন বোস অ্যাভিনিউতে মিশেছে, সেখানে দাঁড়িয়ে সাইকেল বিড়িতে শেষ সুখটান দিচ্ছিল জগা। আমায় দেখে যেন ভূতের মতো চমকে উঠল। আমি ওকে না দেখার ভান করে যেই রাস্তা পার হতে যাব, অমনি দিব্যি ঝকঝকে আকাশ থেকে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। জগা তো তাই দেখে পড়ি কি মরি করে ছুট। আমি মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে কাকভেজা ভিজতে ভিজতে চেঁচিয়ে উঠলাম, ওরে জগা পালাস না বাপ আমার, তোকে আমি আর খিচুড়ি রাঁধতে বলব না!
বিশ্বাস করুন, বর্ষাকাল এলেই খিচুড়ি নিয়ে এই স্বপ্নটা জগা-খিচুড়ি হয়ে আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। সেই হাফ-প্যান্ট বয়স থেকেই অভ্যেস, আকাশ থেকে দু-এক ফোঁটা জল ঝরল কী ঝরল না, অমনি রোজকার মেনুতে ভাতের বদলে খিচুড়ি। এতে আবার অবাকের কী? বাঙালি মাত্রেই এই রোগ ঘরে ঘরে। সত্যিই, এই সময়ে বাঙালি জীবনে ভাত-ডালের সঙ্গে মেলামেশাটা যেন হঠাৎ করেই একটু বেড়ে যায়। |
|
ছবি: দেবাশীষ দেব |
আজকাল তো আবার ফেসবুকে স্টেটাসও হয়, আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, খিচুড়ি দেব মেপে!
কিন্তু শুধুই কি খিচুড়ি? সঙ্গতে, পাঁপড়ভাজা থেকে ডিমের অমলেট হয়ে ঐশ্বরিক ইলিশ, কাকে ছেড়ে কার কথা বলি! আর খিচুড়িও কি এক রকম? পুজোর খিচুড়ি ভোগ এক তো, ভুনিখিচুড়ি আর এক। মা-মাসিমার হাতবদলেও বদলে যায় খিচুড়ির স্বাদ। ঠিক যেমন, চাল বা ডাল বদলালে, খিচুড়ির আস্বাদ পাল্টে যায় নিমেষে। মুসুরির ডালের খিচুড়ির যা টেস্ট, মুগ ডাল হলে আবার অন্য রকম। তাই খিচুড়ি চালে-ডালে এক হলেও, রসনাবৈচিত্র্যে রীতিমত একাধিক। আর এত সহজ রেসিপি, ক’টা খাবারের হয় বলুন তো? চিনেরা দাবি করে, চাইনিজ নাকি বিশ্বের সব চেয়ে সহজ ফর্মুলা, আমি বলব, খিচুড়ির ধারেকাছে কেউ নেই। যে জীবনে রান্নাঘরেও ঢোকেনি, সেও খিচুড়ি বানাতে পারবে। আজকাল তো খুব ফিউশন রেসিপির কথা শোনা যায়, খিচুড়ি হচ্ছে সেই ফিউশনের আদি সংস্করণ। ইতালিয়ানরা যে রিসোত্তো রাঁধে, সেও তো বাংলা খিচুড়ি মশাই!
এখন তো আবার বৃষ্টিও ভুগোলবিশেষে ভ্যারি করে। হাতিবাগানে বৃষ্টি হচ্ছে, তো গড়িয়াহাটে ঠা-ঠা রোদ্দুর। লোকাল ওয়ার্মিং-এর চোটে বাঙালির আজ ত্রাহি মধুসূদন কেস, আলিপুর যদি বলে আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে, তো দেখবেন মেঘটেঘের কোনও সিনই নেই। তাই, আপনি যে ওয়েদার ফোরকাস্ট দেখে গিন্নিকে খিচুড়ির রিকুইজিশন দেবেন, তা হওয়ার জো নেই। আর শুকনো দিনে খিচুড়ি, ঠিক কেমন যেন লাগে।
আমার এই গপ্পটি অবশ্য একেবারে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, যদি সঙ্গতকারীদের কথা না বলি। আর এই ব্যাপারে, আমার এবং আপামর বাঙালির লিস্টিতে প্রথম নাম মাছের রাজার, অর্থাৎ ইলিশ। ভেবে দেখুন, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হতে না হতেই খবরের কাগজে শিরোনাম : বাংলাদেশ থেকে ঢুকছে ইলিশ বোঝাই ট্রাক। এমন পরমাস্বাদনীয় বস্তুটির কথা ভাবতেও কী যে ভাল লাগে, আহা! খিচুড়ির সঙ্গে ইলিশমাছ ভাজা দিয়ে, অফিস ডুব মেরে, রেনি ডে এনজয় করতে ভালবাসেন না, এমন বাঙালি প্রজাতি বিরল। আমার এর বন্ধুকে জানি যে তার বস-এর বাড়িতে ইলিশ মাছ পাঠিয়ে রেনি ডে-র জন্যে অ্যাপ্লাই করে ফি বছর। ছুটি মঞ্জুর না করে ওপরওয়ালা আর যায় কোথায়?
অবশ্য শুধু ইলিশের কথা বললে অন্য ভাজাগুলোর প্রতি অন্যায় করা হবে। সামান্য ডিমভাজাও যে খিচুড়ির সঙ্গে এত ভাল যায়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর পাঁপড়, তাকে তো খিচুড়ির অর্ধাঙ্গিনীই বলা যায়! এমন লং লাস্টিং মানিকজোড়, সুখাদ্যের ইতিহাসে পাকা জায়গা নিয়ে বসে আসছে বছরের পর বছর ধরে। পাঁপড় আবার ভাজা ও সেঁকা, দুয়েতেই সমান উপভোগ্য। এ ছাড়া বেগুন, পটল, আলু ইত্যাদি-প্রভৃতির ভাজা তো আছেই।
আর একটা জিনিসের কথা না বললেই নয়। খিচুড়ির সঙ্গে যেটা মাস্ট। সেটা হল গিয়ে ঘি, গাওয়া হলে তো কথাই নেই। ওই জিনিসটি ছাড়া, আর যাই হোক খিচুড়ি হয় না। গরম গরম খিচুড়িতে দু’চামচ গব্য ঘৃত, আহহ! এমন স্বাদ জন্ম-জন্মান্তরেও ভুলিব না।
শেষ পাতে, আমার গুরুস্থানীয় খিচুড়ি-শেফ জগাদা’র কথায় ফিরে আসি। শুনছি, সে নাকি আজকাল লন্ডনের বাঙালি পাড়ায় একটা নতুন দোকান খুলে বসেছে। সাহেব-সুবোরা বেশ লাইন দিয়ে সেই রেস্তোরাঁয় ভিড় জমাচ্ছে। দোকানের মাথায় জ্বলজ্বল করছে মস্ত নিওন সাইন -জগা’স খিচুড়ি, হোয়্যার এভরি ডে ইজ আ রেনি ডে... |
|
|
|
|
|