রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘিরে শরিকি টানাপোড়েন ছিলই। সোমবার তা আরও চড়া হল। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে বিধানসভা ভবনে কংগ্রেস মন্ত্রী-সাংসদ-বিধায়করা দলীয় নেতৃত্বকে জানিয়ে দিলেন, ১৯ জুলাইয়ের পর তাঁরা তৃণমূলের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ‘সম্মুখ সমরে’ নামতে চান। কারণ, প্রতিনিয়ত তৃণমূল তাঁদের ‘অপমান’ করছে। সনিয়া গাঁধী থেকে শুরু করে প্রণববাবু বা পি চিদম্বরমের মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের ‘হেনস্থা’ করা হচ্ছে। এর প্রতিবাদে ও প্রতিরোধে তাঁরা আন্দোলনে নামতে দলীয় নেতৃত্বের অনুমতি চেয়েছেন।
হাইকম্যান্ডের তরফে তাঁদের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। কংগ্রেসের নেতাদের বক্তব্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ পর্যন্ত কী করেন, তা দেখে নিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে চান শীর্ষনেতৃত্ব।
কংগ্রেসের একাংশের মতে, এ দিন প্রণববাবু-সিপিএম প্রকাশ্য বৈঠকের পর রাজ্যে কংগ্রেসের ‘অস্বস্তি’ আরও বাড়ল। এই আবহে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কংগ্রেস-বিরোধিতাও তীব্রতর হবে (যা সিপিএম-ও চাইছে)। ফলে কংগ্রেসের উচিত ‘নিজস্ব সত্ত্বা’ তৈরি করা। তা করতে গেলে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ‘সর্বাত্মক’ আক্রমণে যেতে হবে। নচেৎ কংগ্রেসের নিচুতলা দ্রুত তৃণমূলে ভিড় জমাবে। পঞ্চায়েত ভোটে সমস্যায় পড়বে কংগ্রেস। ফলে রাজ্য রাজনীতিতে ‘প্রাসঙ্গিক’ থাকতে কংগ্রেসকে নানা বিষয়ে ‘ধারাবাহিক আন্দোলনে’ থাকতে হবে। সেই আন্দোলন হতে হবে ‘জনমুখী তথা প্রতিষ্ঠান-বিরোধী’। যে কারণে এ দিনই অধীর চৌধুরী ঘোষণা করে দিয়েছেন, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, পুরুলিয়ায় কংগ্রেস পঞ্চায়েতে একা লড়বে!
রাজ্য বিধানসভার নৌশর আলি কক্ষে এ দিন দলীয় বিধায়ক-সাংসদদের কাছে ভোটের প্রচার-বৈঠকে প্রণববাবুর সঙ্গেই ছিলেন এআইসিসি-র দুই সাধারণ সম্পাদক শাকিল আহমেদ ও রামচন্দ্র কুন্তিয়া। তাঁদের কাছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন রায়গঞ্জের সাংসদ দীপা দাশমুন্সি। বৈঠকের পরেও তিনি বলেন, “আমি শাকিল’জিকে বলেছি, বাংলার কংগ্রেস প্রতিনিয়ত অপমানিত হচ্ছে। সনিয়া গাঁধী থেকে শুরু করে প্রণবদা, চিদম্বরমজিকে হেনস্থা করা হচ্ছে। এটা আমরা আর সহ্য করব না।” বৈঠকের পরে বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরীও বলেন, “কংগ্রেস যে তৃণমূলের তল্পিবাহক নয়, তা প্রমাণ করার সময় এসেছে।” প্রণববাবুকে এখনও সমর্থন না-করার জন্য বৈঠকে নাম না-করে তৃণমূলের সমালোচনা করেন রাজ্যের মন্ত্রী মানস ভুঁইয়াও। বৈঠকের পর মানসবাবু বলেন, “যাঁরা বলছেন প্রণববাবু বাংলা ও বাঙালির জন্য কিছু করেননি, তাঁদের জবাব দিতে পুস্তিকা প্রকাশের জন্য দলীয় নেতৃত্বের অনুমতি চেয়েছি। ১৯ জুলাই ভোট মিটলেই পুস্তিকা বার করে দেখিয়ে দেব!”
লক্ষণীয়, তৃণমূলের বিরুদ্ধে দীপারা রাজনৈতিকভাবে লড়াইয়ে নামতে চাইছেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন মেটার পরে। কংগ্রেস নেতাদের একাংশের বক্তব্য, শেষ পর্যন্ত মমতা কী সিদ্ধান্ত নেন, তা দেখার পরেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। ফলে ১৯ জুলাই পর্যন্ত অপেক্ষা করাটাই শ্রেয়। বিশেষত, যখন হাইকম্যান্ড এখনও মমতা-বিরোধিতার পথে হাঁটতে নারাজ। পরিষদীয় দলের সঙ্গে বৈঠকের শেষ দিকে দীপা যখন তৃণমূলের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইতে নামার জন্য হাইকম্যান্ডের অনুমতি চান, তখন শাকিলও তাঁকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত কোনও মন্তব্য না করলেও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যও বৈঠকের পর বলেন, “পরিস্থিতি অনুযায়ী দলের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
বস্তুত, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ থেকে শুরু করে পেনশন বিল-সহ নানা বিষয়ে ইউপিএ-২ সরকারের অন্দরে শরিকি ঝামেলা আছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি পদে প্রণববাবুর প্রার্থিপদ নিয়ে কংগ্রেস-তৃণমূল সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের বিরোধিতা করা ছাড়া তাঁদের আর উপায় নেই বলেই কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতা মনে করেন। তাঁরা এ-ও জানেন, কংগ্রেস সরকার ছেড়ে বেরিয়ে এলেও মমতার সরকার পড়ে যাবে না। ফলে সরকার ভাঙায় ‘দায়’ও কংগ্রেসের উপর ‘বর্তাবে’ না। বরং, দলের অপমানের প্রতিবাদে বেরিয়ে এলে তাঁরা ‘শহিদে’র মর্যাদা পাবেন।
এ দিনের বৈঠক থেকেই তা শুরু হল বলে দলের নেতাদের একাংশ মনে করছেন। বৈঠকে দীপা, অধীর, মানস কেউ সরাসরি নাম করে, কেউ বা নাম না-করে তৃণমূলের সমালোচনা করেন। মানসবাবু বলেন,অদ্ভুত কিছু প্রশ্ন তুলে এই বাংলার কেউ কেউ প্রণববাবুকে সমর্থন করছেন না। এই বিষয়টি ‘দুর্ভাগ্যজনক’। বৈঠকের পর অধীর বলেন, “তৃণমূলের সঙ্গে আমাদের নির্বাচনী আঁতাঁত প্রণববাবুর নেতৃত্বেই হয়েছিল। প্রণববাবুও সিপিএমের অপশাসনের শেষ চেয়েছিলেন। তাঁর কাছে তৃণমূলের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কিন্তু আমাদের অন্য রাজ্যের সাংসদদের থেকে শুনতে হচ্ছে, প্রণববাবু রাষ্ট্রপতি হোন, এটা কি বাঙালিরা চায় না?” |