তেতাল্লিশ বছর পরে তাঁর ‘বৃত্ত সম্পূর্ণ’ হল। মনে করছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।
দীর্ঘ রাজনৈতিক পরিক্রমা পেরিয়ে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রচারে নিজভূমে এসে সোমবার সে কথাই বললেন ঈষৎ ‘আবেগতাড়িত’ প্রণববাবু।
সিপিএম, ফরওয়ার্ড ব্লক, ডিএসপি এবং সমাজবাদী পার্টি বামফ্রন্টের চার শরিকদল এবং কংগ্রেস বিধায়কদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর পর বর্ষীয়ান রাজনীতিক স্মৃতিপথে ফিরে গেলেন তেতাল্লিশ বছর আগে। তাঁর রাজনীতির জীবন শুরুর দিনে। স্মৃতিমেদুর ‘হবু রাষ্ট্রপতি’ সাংবাদিকদের বললেন, “এ রাজ্য থেকেই প্রথম রাজ্যসভার সাংসদ নির্বাচিত হই। দিনটা ১৯৬৯ সালের ৪ জুলাই। সে দিন রাজনীতি শুরু করেছিলাম। আর ২০১২-র জুলাইয়ে এই রাজ্যে এলাম রাষ্ট্রপতি পদে সমর্থন চাইতে। তেতাল্লিশ বছর পর একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল!”
জুলাই-সমাপতনে সেই বৃত্তেই জড়িয়ে গেল বিধানসভা ভবন। বাম-কংগ্রেস দুই বৈঠকেই সেই সমাপতনের কথা সাংসদ-বিধায়কদের শুনিয়েছেন। পরে বললেন, “১৯৬৯ সালে বিধানসভার কাউন্সিল চেম্বারেই (অধুনা সৈয়দ নৌশর আলি কক্ষ) রাজ্যসভার ভোট হয়েছিল। ওই ঘরেই ভোটগণনা এবং সেখানেই রিটার্নিং অফিসারের হাত থেকে সার্টিফিকেট নিয়েছিলাম। সেই ঘরেই রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে বৈঠক করলাম চার বামদল ও কংগ্রেসের সঙ্গে।”
প্রথম বার সাংসদ হওয়ার সেই দিনে ‘তরুণ’ প্রণবের কথাও শুনিয়েছেন দুই বৈঠকেই। অতীত-রোমন্থনে জানিয়েছেন, ফল প্রকাশের আগে পর্যন্ত তিনি ভয়ঙ্কর উদ্বেগে ছিলেন। বছর চৌত্রিশের প্রণবকে উদ্বিগ্ন দেখে সে দিন বামনেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী সাহস জুগিয়েছিলেন। যা শুনে বাম বৈঠকে মুর্শিদাবাদের ডোমকলের বিধায়ক ও প্রাক্তন মন্ত্রী আনিসুর রহমান জানান, প্রণববাবু আর তিনি একই জেলার (মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর থেকেই প্রণববাবু নির্বাচিত সাংসদ) হলেও মতবিরোধ ছিলই। তবুও এক বার বিমানে যেতে যেতে প্রণববাবুর কাছে একটি ব্যাপারে সাহায্য চেয়েছিলেন। নিরাশ হননি।
প্রণববাবুকে সামনে পেয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন অগ্রজ-অনুজ কংগ্রেস নেতারাও প্রবীণ জ্ঞানসিংহ সোহনপাল থেকে আসিফ মেহবুব। রাষ্ট্রপতি হলে ‘অভিভাবক’ প্রণববাবুর সঙ্গে তাঁদের ‘দূরত্ব’ বেড়ে যাবে, বলেন বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরী। অগ্রজের কাছে কংগ্রেস বিধায়ক অজয় দে আব্দার করেন, প্রণববাবুর সঙ্গে দেখা করতে যেন রাষ্ট্রপতি ভবনে যেতে পারেন। তাঁদের রাজনৈতিক জীবনে সেটুকুই স্মৃতি হয়ে থাকবে। প্রদেশ সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য পরে জানান, ‘অভিভাবকে’র মতোই প্রণববাবু তাঁদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে গিয়েছেন। তিনি বলেন, “প্রণবদা আমাদের বলেছেন, যে পদেই থাকি না কেন, সব সময় তোমাদের মধ্যেই থাকব।”
প্রণববাবুর প্রথম ভোট-লড়াইয়ের ভোটার ছিলেন কংগ্রেসের প্রবীণতম বিধায়ক জ্ঞানসিংহ। তিনি অনুজকে ‘আশীর্বাদ’ করে হাতে তুলে দেন তরবারি। রাজ্যের মন্ত্রী মানস ভুঁইয়ার উপহার গাঁধীমূর্তি ও তাঁর বিধানসভা কেন্দ্র সবংয়ের মাদুর। মুর্শিদাবাদের কাঁসার থালা দিয়ে অভিনন্দন জানান কংগ্রেস পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাব। বাঁকুড়ার ‘ঐতিহ্য’ টেরাকোটার একজোড়া ঘোড়া উপহার দেন স্থানীয় বিধায়ক সৌমিত্র খান। ফুলিয়া-শান্তিপুরের মুগা ও সুতির একজোড়া উত্তরীয় প্রণববাবুকে পরিয়ে দেন নদিয়ার শান্তিপুরের বিধায়ক অজয়বাবু। তসরের চাদরে হবু রাষ্ট্রপতিকে শুভেচ্ছা জানান পুরুলিয়ার বিধায়ক নেপাল মাহাতো। সিপিএম নেতা সুশান্ত ঘোষ প্রণববাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে তাঁকে পাঞ্জাবির সোনার বোতামও উপহার দেন। অগ্রজ-অনুজের এমন আবেগ-শুভেচ্ছায় ‘আপ্লুত’ প্রণববাবুও। সতীর্থদের ‘ধন্যবাদ’ জানিয়ে বিদায় নেওয়ার সময় তিনি রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে বলেন, “পেয়েছি ছুটি, বিদায় দেহ ভাই। সবারে আমি প্রণাম করে যাই।...দিয়েছি যা, নিয়েছি তার বেশি...।” তাল কেটে গেল একবারই। দীর্ঘক্ষণ বিধানসভায় কাটালেও স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেননি প্রণববাবু। সকাল ১১টা থেকে নিজের কক্ষেই ছিলেন স্পিকার। তাঁর সঙ্গে দেখা না-করেই বিধানসভা ভবন ছাড়েন প্রণববাবু। বিকেলের বিমানে ফিরে যান দিল্লি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিমানবাবু বলেন, “ওঁর সৌজন্যবোধ না-থাকলে আমি কী করব! স্পিকার পদটা যে রাজনীতির ঊর্ধ্বে, এটা বোধহয় উনি গুলিয়ে ফেলেছেন! উনি রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী। রাষ্ট্রপতি পদ যেমন কোনও দলের হয় না, স্পিকারও তাই।” |