চাষ বাঁচাতে এখন চাই এক দিনের ম্যাচ বা টি-টোয়েন্টির ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিং। তার বদলে টেস্টের ঠুকঠুক ব্যাটিংই চালিয়ে যাচ্ছে বর্ষা। ফলে হতাশ করেছিল জুন। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহও নিরাশ করল!
বর্ষা এ বার দৌড়টাই শুরু করেছিল দেরিতে। জুনে দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে বৃষ্টির ঘাটতি ফলে দক্ষিণবঙ্গে চাষ শুরু করতেই বিলম্ব হয়ে গিয়েছে। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না-হওয়ায় বিভিন্ন জেলায় বীজতলায় ধানচারার বৃদ্ধি তেমন হয়নি। পাটের জন্য মেলেনি পর্যাপ্ত জল। তাই জুলাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন দক্ষিণবঙ্গের কৃষকেরা। কিন্তু জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহও পর্যাপ্ত বৃষ্টি দিতে না-পারায় গাঙ্গেয় বঙ্গের কৃষিভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
রাজ্যে কৃষির নিরিখে আগামী ১৫টা দিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময় বলে জানাচ্ছেন আবহবিদেরা। ওই ১৫ দিন কতটা বৃষ্টি হয়, তার উপরে নির্ভর করছে দক্ষিণবঙ্গের ধান-ভাগ্য। পাট-ভাগ্যও।
আবহাওয়া দফতর কী বলছে?
উপগ্রহ-চিত্রে দেখা যাচ্ছে, হরিয়ানা, দক্ষিণ উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড হয়ে একটি নিম্নচাপ অক্ষরেখার সৃষ্টি হয়েছে। যা দক্ষিণবঙ্গের উপর দিয়ে গিয়েছে। হাওয়া অফিস বলছে, ওই অক্ষরেখাটি সক্রিয় হলে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। না-হলে বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি চলবে।
কিন্তু বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিতে এখন আর চাষ-আবাদের কোনও সুরাহা হওয়ার নয়। ফসল বাঁচানোর জন্য দক্ষিণবঙ্গে এখন মুষলধারে বৃষ্টি চাই কয়েক দিন। অথচ রবিবার পর্যন্ত ধারাবর্ষণের কোনও লক্ষণই নেই। ফলে জুনের শেষে দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টির ঘাটতি যেখানে ছিল ৪৩ শতাংশ, জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের পরে দেখা যাচ্ছে, সেটা বেড়ে হয়েছে ৪৬ শতাংশ। বস্তুত সারা দেশেই সামান্য হলেও বেড়েছে ঘাটতি। জুনের শেষে সারা দেশের হিসেবে বৃষ্টির ঘাটতি ছিল ২৯ শতাংশ। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের পরে তা বেড়ে হয়েছে ৩০ শতাংশ।
দিল্লির মৌসম ভবনের আবহবিদেরা জানাচ্ছেন, জুলাইয়ের প্রথম সপ্রাহে বর্ষা গুজরাত, রাজস্থান-সহ নতুন নতুন এলাকায় ঢুকলেও তার শক্তি বাড়েনি। দুর্বল বর্ষা হঠাৎই বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ায় দেশের বেশির ভাগ এলাকা আশানুরূপ বৃষ্টি পায়নি। তার জেরে বৃষ্টির ঘাটতি বেড়েছে সর্বত্রই। জুনে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তিন রাজ্য (অসম, অরুণাচলপ্রদেশ ও সিকিমে) এবং উত্তরবঙ্গের তিন জেলায় অতিবৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে সেখানেও বৃষ্টির হার কমেছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে (গোটা পূর্ব ভারত এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চল যার অন্তর্গত) জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে বৃষ্টির ঘাটতি ৭২ শতাংশ।
জুনের গোড়া থেকে বৃষ্টি কম হওয়া সত্ত্বেও দিল্লির মৌসম ভবনের আশ্বাস, জুলাই-অগস্টে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হবে দেশে। ফলে সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যেই ঘাটতি মিটে যাবে। প্রথমে ঢিমে তেতালায় চললেও শেষ মুহূর্তে গতি পাবে বর্ষা। ফলে স্বাভাবিক বর্ষণের যে-পূর্বাভাস তাঁরা দিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত তা মিলে যাবে বলে মনে করছেন মৌসম ভবনের আবহবিদেরা।
কৃষি-বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কাটা ঠিক এখানেই। আশঙ্কা ওই ‘শেষ পর্যন্ত’ কথাটাকে ঘিরেই। মৌসম ভবনের গণনা মিলিয়ে শেষ বেলায় হয়তো তুমুল বর্ষণ হয়ে অঙ্কের নিয়মে বর্ষার ‘স্বাভাবিক’ তকমা অটুুট থেকে গেল। কিন্তু চাষি বা চাষের তো তাতে কোনও লাভ হবে না। কৃষি-বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, প্রতিটি ফসল রোয়া বা বপন করার একটা নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। তার জন্য সুষম বর্ষণ চাই। ‘নির্দিষ্ট’ সময়ে সেই বৃষ্টিটা না-হলে ফসল টিকিয়ে রাখা মুশকিল। এ ব্যাপারে কৃষি-বিশেষজ্ঞেরা দক্ষিণবঙ্গে আমন ধানের কথা বলছেন। আমনের বীজতলা তৈরির সময় থেকেই বিশেষ ভূমিকা নেয় বৃষ্টি। এ বার বর্ষা কৃপণতা করায় আমন সেই আঁতুড়ঘরেই বিপন্ন। এক কৃষি-বিশেষজ্ঞের কথায়, “জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সময় আছে। তার মধ্যে আশানুরূপ বৃষ্টি না-হলে আমন ধানের ফলনে ভরাডুবির আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।”
আর সেই ভরাডুবিতে সব থেকে বড় ভূমিকা থাকবে বর্ষার তুঘলকিপনার। রাজ্যের কৃষি দফতরের এক কর্তা বলেন, “আবহাওয়া দফতর বলেছে, স্বাভাবিক বৃষ্টি হবে। কিন্তু সেই বৃষ্টিটা যে জুন থেকে সেপ্টেম্বর জুড়ে একই ভাবে নির্দিষ্ট ছন্দে হবে, তেমন সম্ভাবনা নেই। ঘাটতি পূরণ করতে গেলে যা বৃষ্টির দরকার, তাতে বন্যার আশঙ্কা
ষোলো আনা। বর্ষার ছন্দটাই নেই। বর্ষা এ বার সামঞ্জস্যহীন।”
|
বৃষ্টি-ঘাটতি বহাল* |
|
এলাকা |
জুনের শেষে |
৬ জুলাই |
সারা দেশ |
-২৯ |
-৩০ |
উত্তর-পূর্ব |
-৪৯ |
-৬২ |
দক্ষিণবঙ্গ |
-৪৩ |
-৪৬ |
|
ব্যতিক্রম |
উত্তরবঙ্গ |
+২৬ |
+১১ |
* শতাংশের হিসেব |
|