প্রথমেই বলে রাখি, রজার ফেডেরার শুধু আমার মতো নগণ্য প্রাক্তন টেনিস প্লেয়ারকেই ভুল প্রমাণ করল না। টেনিসপণ্ডিতদের বোকা বনে যাওয়ার দলে আছে জন ম্যাকেনরোর মতো প্রাক্তন মহাতারকাও। লন্ডনের রবিবারের কাগজেই ম্যাকেনরো লিখেছিল, ‘ফেডেরারের আর গ্র্যান্ড স্লাম জেতা মুশকিল।’ কিন্তু আমাদের মতো ‘টেনিসপণ্ডিত’দের ফেডেরার বুঝিয়ে দিল, ও কত বড়মাপের প্লেয়ার! ফাইনালে অ্যান্ডি মারেকে ৪-৬, ৭-৫, ৬-৩, ৬-৪ হারিয়ে ১৭ নম্বর গ্র্যান্ড স্লাম জেতার পর এখন আর কোনও সন্দেহই রইল না যে, ফেডেরারই সর্বকালের সেরা টেনিস প্লেয়ার।
ফেডেরারের আগে ৮ বার উইম্বলডন ফাইনাল কেউ খেলেনি। ৭ বার চ্যাম্পিয়ন ফেডেরার ছাড়া শুধু পিট সাম্প্রাস হয়েছে। যার রেকর্ড ছুঁয়ে ফেডেরার কোর্টেই জানিয়ে দিল, সাম্প্রাসই ওর আদর্শ। ঠিক পরের মাসের ৮ তারিখ ৩১-এ পা দেবে ফেডেরার। এই বয়সে আবার বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বরে উঠে এল আজই। সেই সঙ্গে সাম্প্রাসের বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে সবচেয়ে বেশি সপ্তাহ (২৮৬) এক নম্বরে থাকার রেকর্ডও ছুঁয়ে ফেলল।
চ্যাম্পিয়নশিপ পয়েন্টে মারের ক্রসকোর্ট রিটার্ন কোর্টের বাইরে পড়তেই ফেডেরার আর নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারেনি। ওর মতো কোর্টে বরাবরের অনাবেগী সুপারস্টারও ঘাসের ওপর শুয়ে কেঁদে ফেলল। মিনিট কয়েক পর কোর্টেই ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় মারেও কেঁদে ফেলল। জয়ী এবং বিজিত দু’জনকেই আমি কখনও এ ভাবে ম্যাচ শেষে কাঁদতে দেখিনি! |
ফেডেরারকে এত বড় ফাইনালে এত নার্ভাস হয়ে খেলা শুরু করতেও কোনও দিন দেখিনি! মারে এ দিনই নিজের কলামে লিখেছিল, ‘আমি ফেডেরারকে ফাইনালে হারাব, প্রায় কেউই ভাবছে না। তবে আমি কিন্তু শেষ পয়েন্ট পর্যন্ত নিজের হৃদয় নিংড়ে খেলব।’ ফাইনালে ঠিক সেটাই দেখলাম মারের খেলায়। আধুনিক টেনিসে মারের মতো ডিফেন্স কারও নেই। ফেডেরার আবার অ্যাটাকিং প্লেয়ার। ঘাসের কোর্টে সেটা আরও ভাল হয় বলে উইম্বলডনে ফেডেরার এত সফল। কিন্ত আজ শুরুতে ঠিক উল্টো ব্যাপার ঘটতে দেখলাম। মারে ওর দুর্ধর্ষ ব্যাকহ্যান্ডের পাশাপাশি ইভান লেন্ডলের কোচিংয়ে উন্নত হওয়া ফোরহ্যান্ড শটে ফেডেরারকে আক্রমণ করছে। আর ফেডেরার ডিফেন্স করতে গিয়ে প্রচুর ‘আনফোসর্ড এরর’ করছে।
প্রথম দেড় খানা সেটে ফেডেরার ফোরহ্যান্ডেই ১২টা শট বাইরে মারল। যার ফোরহ্যান্ড কিনা টেনিস ইতিহাসেই সেরা মেনে নেওয়া হয়েছে! মারে আগের তিনটে গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনালে একটাও সেট জেতেনি। ফেডেরারের কাছেই ২০০৮ যুক্তরাষ্ট্র ওপেন আর ২০১০ অস্ট্রেলীয় ওপেন ফাইনালে হেরেছে। আজই মারের গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনালে প্রথম সেট জেতার স্বাদ পাওয়া। কিন্তু সেই ছন্দটা ধরে রাখতে পারল না নিজের দোষেই। ফেডেরারের ব্যাকহ্যান্ডকে টার্গেট করার যে বাস্তবোচিত স্ট্র্যাটেজি মারে নিয়েছিল, সেটার থেকে দ্বিতীয় সেটের মাঝামাঝি স্কটিশ তরুণ যে কেন সরে গেল, বুঝলাম না।
বৃষ্টি নামায় সেন্টার কোর্টের ছাদ ঢাকার জন্য ৪০ মিনিট খেলা বন্ধ থাকার পর মারে যেন আরও ফেডেরারের সেই প্রিয় ‘ফোর স্কোয়ার মিটার এরিয়া’তে রিটার্ন করতে শুরু করল। কোর্টের মাঝামাঝি একটা চার বর্গমিটার জায়গায় প্রতিদ্বন্দ্বীর রিটার্ন পেতে আর নিজে কোর্টের উল্টো দিকে ঠিক ও রকম একটা অঞ্চলেই শট নিতে দারুণ ভালবাসে ফেডেরার। তবে ফেডেরার ম্যাচটা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিল তৃতীয় সেটের সপ্তম গেমে। মারের ওই সার্ভিসে ১০ বার ‘ডিউস’ হল! ২০ মিনিটের ওপর গেমটা চলল! সবচেয়ে বড় কথা, মারে রিটার্ন করতে গিয়ে তিন-তিন বার কোর্টে আছাড় খেয়ে নিজের সার্ভের পাশাপাশি মেজাজও হারাল। যে ছেলেটা ঘরের মাঠে সমগ্র ব্রিটিশ জাতির পাহাড়প্রমাণ প্রত্যাশার চাপ নিয়েও সাবলীল ভঙ্গিতে খেলতে শুরু করে গোটা টেনিসমহলকে চমকে দিয়েছিল, সে কিনা কোন অজ্ঞাত কারণে ভুলে বসল, তার প্রতিদ্বন্দ্বী সেন্টার কোর্টে গত ৯ বছরে সাত বার ফাইনাল খেলে মাত্র এক বার হেরেছে (সেটাও নাদালের বিরুদ্ধে ২০০৮-এর সেই মহাকাব্যিক ফাইনাল)! তৃতীয় সেটের মাঝামাঝি থেকে ফেডেরার ওর সেমিফাইনালের ফর্মে ফিরতেই মারে নেতিয়ে পড়ল। তখন রজারের চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট মারেকেই ক্লান্ত আর নার্ভাস দেখাচ্ছিল!
মারের আর ফ্রেড পেরি হওয়া হল না! বানি অস্টিন হয়েই থাকতে হল। ৭৬ বছরের ইতিহাস ছোঁয়া হল না। ৭৪ বছর পরে আরও এক ইংরেজ উইম্বলডন ফাইনালিস্ট হয়েই থাকতে হল। আর উইম্বলডনের রাজা ফেডেরারের নিজের সাম্রাজ্যে প্রত্যাবর্তন ঘটল। মাছ যেমন জলে, ফেডেরারও তেমনি ঘাসের কোর্টে! সাবলীল। স্বচ্ছন্দ। সুন্দর। |