লোকসভা নির্বাচনের প্রায় দু’বছর বাকি। তার আগে সরকার ও দলের মধ্যে কোনও রকম মতান্তর প্রকট হতে দিতে চাইছেন না কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী। কংগ্রেস শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, এ ব্যাপারে সনিয়া এতটাই সক্রিয় যে, তাঁর নেতৃত্বাধীন জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদের (এনএসি) কাজকর্মেও অনেকটাই রাশ টেনেছেন তিনি। পরিষদের পুনর্গঠন করে হর্ষ মন্দার, এম এস স্বামীনাথন এবং মাধব গ্যাডগিলের মতো তিন সদস্যকে সরিয়ে সরকারের সঙ্গে বিতর্ক বন্ধ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। একই সঙ্গে পরিষদের বৈঠকও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
দশ জনপথের ঘনিষ্ঠ কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “সামাজিক প্রকল্প প্রণয়ন ও তার রূপায়ণ নিয়ে সরকারকে পথ দেখানোর জন্যই সনিয়ার নেতৃত্বে জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়েছিল। যাতে কেন্দ্রে জোট সরকার চললেও সামাজিক প্রকল্পগুলির জন্য সনিয়া গাঁধীকে কৃতিত্ব দিয়ে রাজনৈতিক লাভ তুলতে পারে কংগ্রেস।” ওই নেতার বক্তব্য, কিন্তু সাম্প্রতিক কালে দেখা গিয়েছে, উপদেষ্টা পরিষদের কিছু সদস্য সামাজিক প্রকল্পগুলি নিয়ে বেশি মাত্রায় সরব। সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এই সদস্যরা এমন সব দাবিদাওয়া রাখছেন, যেগুলি পূরণ করার ক্ষমতা সরকারের নেই।
যেমন খাদ্য সুরক্ষা নিয়ে সরকার যে বিল তৈরি করেছে, তাতে আপত্তি রয়েছে হর্ষ মন্দারের। সে ব্যাপারে তাঁর আপত্তির কথা তিনি শুধু পরিষদের বৈঠকের মধ্যেই সীমিত রাখেননি, প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েও জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, “সরকার খাদ্য সুরক্ষা নিয়ে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আর যে বিল কেন্দ্র তৈরি করেছে, তার মধ্যে বিস্তর ফারাক। এতে মানুষের প্রত্যাশাপূরণ হবে না।” একই ধরনের মত জানিয়েছেন এম এস স্বামীনাথনও। তাঁর বক্তব্য, গণবণ্টন ব্যবস্থার আওতায় দেশের সব মানুষকে আনা হোক। খাদ্য সুরক্ষা আইনের খসড়া প্রস্তুতির সময় গোড়ায় সেই ধারণাই ছিল। এবং মনে করা হয়েছিল, গোটা পৃথিবীর মধ্যে এই আইন সব থেকে বড় সামাজিক সুরক্ষার দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে তা হচ্ছে না। আবার খনি নীতি নিয়ে কেন্দ্রের অবস্থানের সঙ্গে ফারাক ছিল মাধব গ্যাডগিলের। প্রকাশ্যে কেন্দ্রের সমালোচনাও করেন তিনি। আবার অরুণা রায় ভূমিসংস্কার-সহ নানা বিষয়ে এমন সব প্রস্তাব দিচ্ছেন, যা সরকারের রক্তচাপ বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট। সরকার পক্ষের বক্তব্য, ব্যক্তিগত ভাবে কেউ সরকারের নীতি নিয়ে এ রকম সমালোচনা করলে খুব একটা সমস্যা নেই। কিন্তু কংগ্রেস নেতাদের মতে, জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের এই ধরনের সমালোচনায় সরকারকে বারেবারেই অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে। কারণ, পরিষদের কোনও সদস্য সমালোচনা করলে এটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, সনিয়ার সম্মতিতেই তাঁরা তা করছেন।
কংগ্রেস সূত্রে বলা হচ্ছে, এই বিতর্কই এড়াতে চাইছেন সনিয়া। কারণ তাঁর কাছেও স্পষ্ট, যে ধরনের নীতির কথা পরিষদের এই সদস্যরা বলছেন, তা সব দিক থেকে আদর্শ হতে পারে, কিন্তু এই সব সাধ ও সরকারের সাধ্যের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বিশেষ করে বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতিতে সব মানুষকে খাদ্য সুরক্ষার আওতায় আনা সম্ভব নয়। সে জন্য যে পরিমাণ অর্থ ও খাদ্যশস্যের সরবরাহ সুনিশ্চিত করতে হবে, তা-ও সরকারের পক্ষে এক প্রকার অসম্ভব। কিন্তু প্রশ্ন হল, তা হলে কি সরকার খাদ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করবে না? সনিয়া-ঘনিষ্ঠ নেতাদের কথায়, “কংগ্রেস সভানেত্রীর মতে কেন্দ্রের আর্থিক ক্ষমতার নিরিখে গ্রাম ও শহরের যত সংখ্যক মানুষের খাদ্য সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা যায়, আপাতত তা করবে সরকার। ২০১৪ সালের আগে তা রূপায়ণ করে কংগ্রেস লোকসভা ভোটে যাবে। কিন্তু এ নিয়ে পরিষদ ও সরকারের মধ্যে ক্রমাগত বিতর্ক চালিয়ে আর দেরি করা ঠিক হবে না।”
প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্রে বলা হচ্ছে, সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে পরামর্শ করেই জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদ থেকে তিন সদস্যকে সরানো হয়েছে। সামাজিক দাবি প্রসঙ্গে কট্টরপন্থী বলে পরিচিত জাঁ দ্রেজ আগেই ইস্তফা দিয়েছেন। আর এক সদস্য রামদয়াল মুণ্ডার সম্প্রতি মৃত্যু হয়েছে। পরিবর্তে সনিয়া-মনমোহন পরিষদে যে দুই নতুন মুখ এনেছেন, তাঁরা কট্টরপন্থী বলে পরিচিত নন। এর মধ্যে এক জন হলেন যোজনা কমিশনের সদস্য মিহির শাহ, অন্য জন হলেন স্বেচ্ছাসেবী আশিস মণ্ডল।
সদস্য বদলের সঙ্গে সঙ্গে পরিষদের বৈঠকও এখন কমিয়ে দিয়েছেন সনিয়া। মাসে অন্তত এক বার পরিষদের বৈঠক হয়। কিন্তু গত দেড় মাসে এনএসি-র কোনও বৈঠক হয়নি। তা ছাড়া গত তিন-চার মাসে যে সব বৈঠক হয়েছে তাতেও এমন কোনও আলোচনা হয়নি যা সরকারকে চাপে বা বিড়ম্বনায় ফেলতে পারে। কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “আসলে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের জন্য উপদেষ্টা পরিষদের যা কাজ ছিল, তা মোটামুটি হয়ে গিয়েছে। শিক্ষার অধিকারের পর খাদ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন হয়ে গেলে এ যাত্রায় রাজনৈতিক ভাবে তা কংগ্রেসের জন্য যথেষ্ট। সেই সঙ্গে অসংগঠিত ক্ষেত্রের সামাজিক সুরক্ষার কাজও প্রায় শেষ করে এনেছেন সনিয়া। সেই কারণে পরিষদের কাজ এখন অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছেন তিনি।” |