|
|
|
|
অলিম্পিকে মশাল বইবে অবহেলিত চা বাগানের পিঙ্কি |
নিজস্ব সংবাদদাতা • গুয়াহাটি |
আর ৪৮ ঘণ্টা বাদেই নটিংহ্যামে লন্ডন অলিম্পিকের মশাল বইতে দেখা যাবে ডিব্রুগড়ে চা বাগান দাপিয়ে বেড়ানো সপ্তদশী শ্যামলবরণ কিশোরীটিকে। পিঙ্কি কর্মকার নামে নামে বরবরুয়া গার্লস স্কুলের দশম শ্রেণির এই ছাত্রীকে ঘিরে ‘আসাম টি কোম্পানি’র অধীনস্থ চা বাগানগুলিতে এখন উৎসবের আবহ। খোদ বিলিতি সাহেবদের হাতে গড়া অসমের এই সব চা বাগান। সেই সাহেবি ধারা বহন করে মেয়েটির বাবা-মা এখনও বাগানের নিম্নতর শ্রেণির প্রতিনিধি। কিন্তু সেই ঘরের মেয়েই বিলেতে ভারতের নাম উজ্জ্বল করতে উড়োজাহাজে উড়ে গিয়েছে, এটুকুই জানেন বাগানের কর্মীরা। অলিম্পিক না কিসের যেন মশাল নিয়ে দৌড়বে মেয়েটা! আর তাতেই বুকের ছাতি ফুলছে তাঁদের। পাশাপাশি, জানার চেষ্টা করছেন অলিম্পিকের মশাল ব্যাপারটা ঠিক কী!
পিঙ্কির বাবা রাজেন কর্মকার বাগানের ‘পেন্টার’। মা লীলা দেবী পাতা তোলেন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে পিঙ্কি চতুর্থ। কিন্তু একেবারেই অখ্যাত পরিবারের মেয়ে এমন জায়গায় উঠে এল কী করে?
ঘটনা হল, এমনিতে মুখচোরা হলেও পিঙ্কির ভাবনাচিন্তাটাই অন্য রকম। পড়াশোনার পাশাপাশি সে দৌড়, লং জাম্প, হাই জাম্প, কবাডি খেলাতেও তুখোড়। তবে শুধু নিজের খেলাটাই চালিয়ে যায়নি পিঙ্কি, অসমের পিছিয়ে থাকা চা বাগান এলাকার ছেলেমেয়েদের মধ্যেও সঞ্চারিত করেছে খেলার প্রতি তীব্র আগ্রহ। নিজের স্কুলে রীতিমতো খেলার দৈনিক ক্লাস চালু করেছে সে। কোনওদিন কারও অভিভাবক বেঁকে বসলে সোজা তাঁদের বাড়ি চলে গিয়ে বুঝিয়ে ছাড়ে, পড়ার পাশাপাশি শরীর গড়াটাও কতটা প্রয়োজন। একই রকম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়ায় পিঙ্কি। গ্রাম পঞ্চায়েতে কমবয়সে বিয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে সওয়াল করে। জেহাদ ঘোষণা করে মদ্যপানের বিরুদ্ধে। হাতে তুলে নেয়, বয়স্ক শিক্ষার দায়ভার। চালায় নাইট স্কুল।মেয়ের স্কুলের প্রথম ছাত্রী মা লীলা।
বিদেশ যাত্রার আগে প্রশ্ন করা হয়েছিল লড়াই করার এমন শক্তি কোথা থেকে পায় সে? পিঙ্কির উত্তর, “কিছুটা জেদ ভিতরে ছিলই। বাকি জোরটা পেলাম ইউনিসেফের ভরসায়।” ইউনিসেফের আন্তর্জাতিক প্রেরণা প্রকল্পের অধীনে ২০টি দেশের এক কোটি ছাত্রছাত্রী ও লক্ষাধিক শিক্ষক-কোচকে নিজেদের স্কুল বা এলাকায় ক্রীড়া প্রসারে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। সাহায্য করে ব্রিটিশ কাউন্সিল, ইউকে স্পোর্ট্স, ব্রিটিশ অলিম্পিক সংস্থা। এর মধ্যে থেকে বাছাই হয় ২৭৩টি স্কুল। ‘আসাম টি কোম্পানি’র অধীনস্থ চা বাগানের দুই নম্বর লাইনে অবস্থিত ‘বরবরুয়া গার্লস স্কুল’ পিঙ্কির হাত ধরেই ওই তালিকায় জায়গা করে নেয়।নানা প্রতিযোগিতা, প্রতিভা অণ্বেষণের রাস্তা পার হয়ে, ভারতের ছয় জন কিশোর-কিশোরী মূল পর্বে পৌঁছয়। তবে, কলকাতার চূড়ান্ত পর্বে, বাকি সকলকে সরিয়ে পিঙ্কিই শীর্ষ স্থান আদায় করে।
পিঙ্কির গর্বিতা মা লীলা দেবী বলেন, “অনগ্রসর এলাকার দারিদ্র সীমার নীচে থাকা একটি পরিবারকেই নয়, একা হাতে পিঙ্কি গোটা চা বাগানকেই আলোকবৃত্তে তুলে এনেছে।” বাগিচার ম্যানেজার মনজিৎ বরুয়া ও তাঁর স্ত্রী মন্দিরা দেবী পিঙ্কির কৃতিত্বে মুগ্ধ হয়ে দশ হাজার টাকা পুরস্কার দিয়েছেন তাকে।
লন্ডনগামী বিমানে ওঠার আগে মোহনবাড়ি বিমানবন্দরে পিঙ্কিকে সংবর্ধনা দেয় আটসা জেলা সমিতি ও আদিবাসী চা জনগোষ্ঠী। পিঙ্কি চায়, বিলেত থেকে ফেরার পর বাগানের নৈশ স্কুলটি আরও ভাল করে চালাতে। আরও অনেক পিঙ্কি গড়ে তোলাই যে স্বপ্ন শ্যামলা জেদি সপ্তদশীর। মশালটা আপাতত তার সেই স্বপ্নেরই প্রতীক। |
|
|
|
|
|