বিশ্বে সর্বাধিক শক্তিশালী অর্থনীতিগুলি একত্রে ‘গ্রুপ অব টোয়েন্টি’ বা জি-২০ নামে একটি সমষ্টি তৈরি করিয়াছিল ২০০৮ সালে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ১৯টি রাষ্ট্র ইহার অংশীদার। রাষ্ট্রগুলির মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ব্রাজিল, চিন, জাপান, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, ভারত-সহ যাহারা স্থান পাইয়াছে, একত্রে সেই ২০টি দেশ বিশ্বের মোট উৎপাদনের প্রায় ৮০ শতাংশ উৎপন্ন করিয়া থাকে, বিশ্ব-বাণিজ্যের ৮০ শতাংশও তাহাদেরই দখলে। এমন একটি আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের সদস্যপদ দেশবাসীর নিকট গৌরবের বিষয়। কিন্তু অর্থ থাকিলেই হইবে না, তাহা সাধারণ নাগরিকের জীবনে কী উন্নতি আনিতে পারিল, সে প্রশ্নও উঠিয়া থাকে। সেই নিরিখে বিচার করিলে যে ফলাফল মেলে, তাহাতে ভারতবাসীকে বারবার সংকুচিত, লজ্জিত হইতে হয়। সম্প্রতি তেমনই এক সমীক্ষার ফল প্রকাশিত হইয়াছে। জি-২০ অন্তর্গত ১৯টি রাষ্ট্রের কোনটি মহিলাদের জন্য কত অনুকূল, নানা বিষয় বিচার করিয়া তাহার মূল্যায়ন করিয়াছে একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমীক্ষা সংস্থা। ভারত ইহাতে সর্বনিম্ন স্থান পাইয়াছে। এমনকী সৌদি আরব, যে দেশে মেয়েরা মাত্র গত বৎসর ভোটাধিকার পাইয়াছে, গণতান্ত্রিক ভারতের চাইতে এক ধাপ উপরে, অষ্টাদশ স্থানে রহিয়াছে। সর্বশীর্ষে আছে কানাডা। ভারতের এই মর্মান্তিক দশা কেন? সমীক্ষায় দেখা গিয়াছে, স্বাস্থ্য, হিংসা হইতে সুরক্ষা, সামাজিক সম্পদ পাইবার সুযোগ এবং পাচার হইতে বাঁচিবার সম্ভাবনা, এই চারটি বিষয়ে ভারতের স্থান সকলের শেষে, ১৯টি দেশের মধ্যে উনিশতম। সৌদি আরবের চাইতে ভারত এক ধাপ উপরে রহিয়াছে কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের সুযোগ দিবার বিষয়ে, আর মেয়েদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণে ভারতের স্থান সপ্তদশ, চিন এবং সৌদি আরবের উপরে। এই চিত্রে কোথাও কোনও সান্ত্বনা পাইবার উপায় নাই।
সমীক্ষাটি নূতন হইলেও, এ সংবাদ নূতন নহে। এক অর্থে ইহার চাইতে আরও প্রবল দুঃসংবাদ মিলিয়াছিল গত বৎসর। অমর্ত্য সেন এবং জঁ দ্রেজ দেখাইয়াছিলেন, দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশের মধ্যেও মানব উন্নয়নের নিরিখে ভারতের স্থান নিম্নমুখী। দুই দশক পূর্বে মহিলা সাক্ষরতা, শিশুপুষ্টি প্রভৃতি যে বিষয়গুলিতে ভারতের স্থান ছিল প্রথম বা দ্বিতীয়, এখন সেই সকল বিষয়ে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপালেরও পশ্চাতে পড়িয়াছে ভারত। এক পাকিস্তান ব্যতীত প্রায় সব দেশই ভারতকে ছাড়াইয়া আগাইয়া গিয়াছে। অর্থাৎ কেবল উন্নত অর্থনীতিগুলির মধ্যেই নহে, দুর্বলতর অর্থনীতির তুলনাতেও ভারত মহিলা উন্নয়নে পিছাইয়া পড়িতেছে। এই সংকট অতি গভীর, এর কোনও সরল সমাধান নাই। জন্মের পূর্ব হইতে কন্যাসন্তানের প্রতি যে গভীর বিদ্বেষ ভ্রূণহত্যার অপরাধ রূপে প্রকাশ পায়, বিবাহের পর তাহাই পণের জন্য নির্যাতন ও হত্যার আকার ধারণ করে। অকালবিবাহ, অকালমাতৃত্ব, বালিকা বা কিশোরীর গৃহশ্রমিক হিসাবে দাসত্ব, প্রসূতিমৃত্যু, এই সকল কারণ ভারতে মেয়েদের জীবনকে অমানবিক করিয়া তুলিয়াছে। সাম্প্রতিক সমীক্ষাটি যাহা আবারও মনে করাইয়া দিল সেই জ্ঞাত সত্যগুলিই। অর্থনীতির বৃদ্ধি আপনিই সামাজিক ন্যায় কিংবা মানব উন্নয়নে পরিণতি লাভ করে না। মহিলাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, হিংসামুক্তি নিশ্চিত করিতে বিস্তর পরিকল্পনা এবং পরিশ্রম প্রয়োজন। সে কাজ সরাইয়া রাখিলে এই ভাবেই বিশ্বের দরবারে ভারতকে বারংবার নিন্দিত, অপমানিত হইতে হইবে। |