অন্ধ্রপ্রদেশের আঠারোটি বিধানসভা আসন এবং একটি লোকসভা আসনের উপনির্বাচনে জগন্মোহন রেড্ডি ও তাঁহার নবীন দলের চমকপ্রদ সাফল্য দেখাইয়া দিতেছে, রাজ্য-রাজনীতিতে সহানুভূতির হাওয়া জগন্মোহনের পালেই প্রবাহিত হইতেছে। কংগ্রেস কিংবা তেলুগু দেশম কেহই এই উপনির্বাচনে প্রাসঙ্গিক থাকে নাই। তেলুগু দেশম তো একটি আসনও পায় নাই। ক্ষুব্ধ দেশম নেতা চন্দ্রবাবু নায়ডু তাঁহার দলের এই বিপর্যয়ে জগন্মোহনের সহিত কংগ্রেসের প্রচ্ছন্ন আঁতাতের ভূতও দেখিতে পাইয়াছেন। এমনকী তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতির মতো প্রভাবশালী দলও মাত্র হাজার খানেক ভোটের ব্যবধানে কোনও ক্রমে পারকল আসনটি জগন্মোহনের কাছ হইতে ছিনাইয়া লইতে পারিয়াছে। আর কংগ্রেস মাত্র দুইটি বিধানসভা আসন লাভ করিয়াছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়ন কাণ্ডে কংগ্রেস নেতৃত্বের কুশলী পরিচালনা যত সাফল্যই পাক, জনাদেশ লাভের ক্ষেত্রে তাহার সময় যে ভাল যাইতেছে না, তাহা নিশ্চিত।
সত্য, যে-সকল আসনে অন্ধ্রে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হইল, জগন্মোহনের অনুগামী রাজনীতিকদের পদত্যাগেই সেগুলি শূন্য হইয়াছিল। কিন্তু হাইকম্যান্ড কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত জগন্মোহনের প্রতি নিজেদের আনুগত্য ঘোষণার আগে পর্যন্ত ওই সব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা কংগ্রেসের টিকিটেই জয়ী হইয়াছিলেন, সেই হিসাবে এই আসনগুলিও কংগ্রেসেরই ছিল। সেই নির্বাচকমণ্ডলীই যখন কংগ্রেস প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত করাইয়া কিংবা পঞ্চম বা চতুর্থ স্থানে পাঠাইয়া দিয়া জগন্মোহনের দলের প্রার্থীদের বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী করান, তখন বুঝিতে হইবে, অন্ধ্রপ্রদেশে কংগ্রেসের ঘাঁটি আর দুর্জয় নয়, তাহাতে বড়-সড় ফাটল দেখা দিয়াছে। এমনকী টি সুব্বি রামি রেড্ডির মতো ওজনদার ও নাম-করা কংগ্রেস নেতাও যখন নেল্লোর লোকসভা কেন্দ্রে জগন্মোহন অনুগামীর কাছে ২ লক্ষ ৯০ হাজারের বেশি ভোটে পরাভূত হন, তখন ২০১৪ সালের নির্বাচনের জন্য দুশ্চিন্তার মেঘ ঘনাইয়া উঠিতে বাধ্য। জগন্মোহনের অনুকূলে যে সহানুভূতির হাওয়া বহিতেছে, তাহার প্রেক্ষিতটি তাঁহার পিতা মুখ্যমন্ত্রী ওয়াই এস রাজশেখর রেড্ডির অপঘাত মৃত্যুতে সূচিত হইলেও পিতার শূন্য সিংহাসনে তাঁহাকে না-বসানোর হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তে তাহা বলবান হয়। বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারে অভ্যস্ত ভারতীয় রাজনীতিতে ইহা এখন আর কোনও দুর্ভাগ্যজনক প্রত্যাশা বলিয়া গণ্য হয় না। উপরন্তু আয়ের সহিত সামঞ্জস্যহীন বিপুল সম্পত্তি সংগ্রহের দায়ে তাঁহার বিরুদ্ধে রাজ্যের কংগ্রেস সরকারের সিবিআই তদন্ত এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জেল-হাজত রাজ্যবাসীর কাছে জগন্মোহনকে রাতারাতি নায়ক বানাইয়া দিয়াছে।
ইহাও ভারতীয় সমাজেরই এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য যে, অণ্ণা হজারের নেতৃত্বে নাগরিক সমাজের দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলন সত্ত্বেও এ দেশে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত রাজনীতিকদের ভোটদাতারা কখনও খলনায়ক মনে করেন না। ব্যতিক্রম বফর্স-কলঙ্কিত রাজীব গাঁধী, যাঁহার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মে জড়িত থাকার অপ্রমাণিত অভিযোগই একটি আস্ত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করিয়া দিয়াছিল। অবশিষ্ট অভিযুক্তরালালুপ্রসাদ যাদব হইতে জয়রাম জয়ললিতা, করুণানিধি হইতে জগন্মোহন রেড্ডিঅন্তত আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকা বা মদত দেওয়ার কারণে ভোটারদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হইয়াছেন, এমন দৃষ্টান্ত বিরল। এই রাজনীতিকরাও সে জন্য বেআইনি ক্রিয়াকলাপে জড়িত হইয়া আদালতে অভিযুক্ত বা বিচারের জন্য নীত হইলে বিন্দুমাত্র লজ্জিত বা সঙ্কুচিত হন না, বরং বুক ফুলাইয়া দাবি করেন, তাঁহারা ‘জনতার আদালতের রায়ে জয়ী’, অন্য কোনও আদালতের পরোয়া করেন না। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র এ ভাবেই ক্রমশ সাংবিধানিক গণতন্ত্রে অন্তর্ঘাত করিয়া চলিয়াছে। |