পূর্ণ অ্যাজিটক সাংমা রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনড় থাকলে বামেদের ভোট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চলেছে। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাংমার লড়াই হলে বামেদের সাড়ে ৫১ হাজারের কিছু বেশি ভোট লোকসভার প্রাক্তন স্পিকারের দিকেই যাওয়া উচিত বলে সিপিএম তথা বাম শিবিরের একটি অংশের মত। ওই বাম নেতাদের বক্তব্য, নবীন পট্টনায়ক ও জয়ললিতা ইতিমধ্যে সাংমাকেই প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে দিয়েছেন। বিজেপি তথা এনডিএ যদি নিজেরা প্রার্থী দেওয়ার বদলে সাংমাকেই সমর্থন জানায়, তা হলেও তাঁকে সমর্থনে বামেদের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
কিন্তু এই মতের বিরোধীরা বলছেন, এনডিএ তথা বিজেপি সাংমাকে সমর্থন করার পরেও যদি তাঁকে ভোট দেওয়া হয় তা হলে সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে এক মঞ্চে ওঠার অভিযোগে কাঠগড়ায় বামেদের কাঠগড়ায় তোলার চেষ্টা হবে।
এমনিতেই পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু ভোটের একটা বড় অংশ তৃণমূলের দিকে চলে গিয়েছে। তার পর এমন ঘটনা ঘটলে সেই সংখ্যালঘু ভোট ফিরে পাওয়ার লড়াই আরও কঠিন হয়ে পড়বে বলেই বাম নেতাদের একাংশের মত। আবার এ পি জে আব্দুল কালাম শেষ পর্যন্ত সত্যিই দৌড়ে না-থাকলে তৃণমূল নেত্রী যদি সাংমাকেই সমর্থন করেন, তা হলে তাঁর সঙ্গে বামেদের এক বন্ধনীতে যাওয়া নিয়েও ‘জটিলতা’ তৈরি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।
কিন্তু এর বিকল্প হিসেবে বামেদের পক্ষে কি প্রণববাবুকে সমর্থন জানানো সম্ভব? প্রণববাবু নিজে বাম নেতাদের ফোন করে সমর্থন চেয়েছেন। এবং সেই প্রশ্ন ঘিরেও বাম শিবিরে জটিলতা তৈরি হয়েছে। চেন্নাইয়ে শনি ও রবিবার বাম শরিক আরএসপি-র দু’দিনের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। আরএসপি-র একটি অংশ ওই বৈঠকে সওয়াল করেছে, নব্য উদারনীতি এবং জনবিরোধী আর্থিক নীতির প্রতিভূ কংগ্রেসের এক জন প্রার্থীকে কী ভাবে বামেরা সমর্থন করতে পারে? আবার অন্য একটি অংশ (তুলনায় সংখ্যায় অল্প) পাল্টা যুক্তি দিয়েছে, বিষয়টিকে ‘নীতিগত প্রশ্ন’ হিসেবে না-দেখে সংসদীয় গণতন্ত্রের ঘটনাপ্রবাহ হিসেবে দেখাই ভাল।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-বিমান বসুরা স্বাভাবিক ভাবেই প্রণববাবুকে সমর্থনের পক্ষে। শুধু বাঙালি বলে নন, ‘ব্যক্তিগত সম্পর্কে’র খাতিরেও প্রণববাবুকে সমর্থন করার পক্ষে মত দিচ্ছেন অনেক সিপিএম নেতা। পাশাপাশি, কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের ‘দূরত্ব’ আরও বাড়ানোর অঙ্কও রয়েছে। কিন্তু দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের শিবির প্রণববাবুকে সমর্থন না করারই পক্ষে। তাদের বক্তব্য হল, কারাটের মূল উদ্দেশ্য কংগ্রেসকে ‘দুর্বল’ করা। এখন তৃণমূল প্রণববাবুকে সমর্থন না-করায় ইউপিএ-তে ফাটল ধরেছে। এ বার বিরোধী দলগুলি এক জোট হলে কংগ্রেস আরও সমস্যায় পড়বে।
সাংমা অনেক আগেই কারাটের সঙ্গে দেখা করে তাঁর সমর্থন চেয়েছেন। অন্যান্য বাম দলের নেতাদের কাছেও দরবার করেছেন। আবার প্রণববাবু-মনমোহন সিংহ শেষ লগ্নে আসরে নেমেছেন। প্রণববাবু যেমন বুদ্ধবাবুকে ফোন করেছিলেন, তেমনই ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের কাছেও সমর্থন চেয়েছেন।
তবে দলের এক পলিটব্যুরো সদস্যের বক্তব্য, “এখানে কোনও ব্যক্তির প্রশ্ন নয়, দলীয় নীতি ও মতাদর্শের প্রশ্ন। যে ইউপিএ সরকারের উদার আর্থিক নীতির বিরোধিতায় বামেরা পথে নামছে, সেই ইউপিএ প্রার্থীকেই সমর্থন করা হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কোঝিকোড় পার্টি কংগ্রেসেও বিজেপি এবং কংগ্রেসের সঙ্গে সমান দূরত্বের কথাই ঠিক হয়েছে।” সাংমাকে সমর্থন করা হলে সব দিকই রক্ষা পায় বলে সিপিএমের একটি সূত্রের বক্তব্য। ইউপিএ-র প্রার্থী হিসেবে প্রণববাবুর নাম ঘোষণা হওয়ার পর তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন বৃন্দা কারাট। কিন্তু শুভেচ্ছা জানানো মানেই বামেরা তাঁকে সমর্থন দেবেন, এমন কোনও প্রতিশ্রুতি দিতে তিনি রাজি নন। সিপিআই নেতৃত্বও সাংমার পক্ষে। এ বি বর্ধনরা মনে করছেন, উত্তর-পূর্বের আদিবাসী নেতা হিসেবে সাংমাকেই সমর্থন করা উচিত বামেদের।
প্রণব ও সাংমাকে ঘিরে বাম শিবিরের বিভাজনের মধ্যে থেকে শেষ পর্যন্ত কোনও ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসবে কিনা সেটাই এখন প্রশ্ন। দিল্লির অজয় ভবনের নেতারা প্রয়োজনে বাম ভোট ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
চেন্নাই থেকে আরএসপি-র কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য অবশ্য এ দিন বলেন, “চার বাম দলের বৈঠকে আমাদের মধ্যেকার দুই ধরনের যুক্তির কথাই বলব। তার পরে সবাই মিলে যা ঠিক করবে, তা-ই মেনে চলব। এই প্রশ্নে বিচ্ছিন্ন কোনও অবস্থান নিতে চাই না।”
উল্লেখ্য, গত বার কংগ্রেসের মনোনীত প্রার্থী বলে প্রতিভা পাটিলকে ভোট দিতেও আরএসপি-র আপত্তি ছিল। তবে ‘বাম ঐক্যে’র স্বার্থে তারা চার বাম দলের মিলিত সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিল।
তবে এনডিএ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বামেরা তাড়াহুড়ো করতে চাইছে না। ২১ জুন চার বাম দলের বৈঠকেই সব ঠিক হবে। |