রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘিরে টানাপোড়েন থেকে এ বার ‘নীতিগত লড়াই’ শুরু করতে চাইছেন তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ফেসবুক পেজ-এ রবিবার মমতা যে ‘পোস্ট’ করেছেন, তা থেকে এমনই ইঙ্গিত মিলছে।
দেশবাসী, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের কাছে দুর্নীতি, ষড়যন্ত্র ও ‘মেকিয়াভেলির ধাঁচে কূট’ রাজনীতির বিরুদ্ধে সরব হওয়ার জন্য ফেসবুকের মাধ্যমে আবেদন জানিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। মমতা লিখেছেন, ‘আমি ভারতীয় নাগরিক এবং অবশ্যই তরুণ প্রজন্মের কাছে আবেদন করব দুর্নীতি, গোপন সমঝোতা (‘ব্যাকরুম ডিল’) ও মেকিয়াভেলি-পন্থী কূটনীতির (মেকিয়াভেলিয়ান ম্যানিপুলেশনস অ্যান্ড মেশিনেশনস) বিরুদ্ধে সরব হওয়ার জন্য’। রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের ব্যাখ্যা, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে ঘটনাপ্রবাহ এবং কংগ্রেসের ভূমিকার প্রতিই প্রচ্ছন্ন কটাক্ষ রয়েছে মমতার মন্তব্যে।
কংগ্রেসের মনোনীত প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য ইতিমধ্যেই প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালামের নাম প্রস্তাব করেছেন মমতা। কালামের সমর্থনে শনিবার থেকেই মমতা তাঁর ফেসবুক পেজ-এ প্রচারও শুরু করেছেন। রাষ্ট্রপতি পদে কালামকে চেয়ে শনিবার কলকাতায় মিছিলও হয়েছে। কিন্তু কালাম শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হতে রাজি হবেন কিনা, সেই বিষয়টি এখনও অনিশ্চিত। অনেকেই মনে করছেন, জয় সুনিশ্চিত না হওয়ায় ভোটে দাঁড়াতে রাজি হবেন না কালাম। বস্তুত প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব পাওয়ার পরে কালাম নিজেই জয় সুনিশ্চিত হওয়ার প্রাক্শর্তের কথা বলেছিলেন। (যদিও তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, এ দিন সন্ধ্যায় মমতাকে ফোন করে সাংমা সমর্থনের আর্জি জানালে মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে কালামকে সমর্থন করার জন্য পাল্টা অনুরোধ করেছেন। যা থেকে তৃণমূল শিবিরের একাংশের ধারণা, গোটা বিষয়টি সহজে ছেড়ে দিতে মমতা নারাজ।) |
মেকিয়াভেলির কথা |
ইতালীয় রাষ্ট্রনীতিক নিকোলো মেকিয়াভেলি। সর্বাধিক আলোচিত বই ‘দ্য প্রিন্স’ ১৫১৩ সালে লেখা। প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পাঁচ বছর পরে, ১৫৩২ সালে। তাতে বলা ছিল, রাজনীতির উদ্দেশ্য সাধনে তথাকথিত অসদুপায়ও নেওয়া যেতে পারে। ‘মেকিয়াভেলীয় নীতি’ বলতে রাজনীতিতে প্রতারণা, হিংসা ও শঠতার আশ্রয় নেওয়া এবং অসাধু পন্থায় কলকাঠি নাড়াই বোঝায়। |
|
তবে এ দিন ফেসবুকে তাঁর আবেদনে কালামের নাম করেননি তৃণমূল নেত্রী। বরং রাষ্ট্রপতি পদে নাম, পাল্টা নামের টানাপোড়েন থেকে গোটা বিষয়টিকে অন্য ‘লড়াই’য়ে নিয়ে যাওয়ার কৌশলের স্পষ্ট ছাপ রয়েছে ওই আবেদনে। ইঙ্গিত রয়েছে, তাঁর এই ‘লড়াই’ সহজে থামবে না।
ফেসবুক প্রচারে যাঁরা কালাম-প্রশ্নে মমতাকে সমর্থন করেছেন, তাঁদের ‘ধন্যবাদ’ জানিয়েছেন মমতা। তিনি লিখেছেন, ‘এত অল্প সময়ের মধ্যে আপনারা যে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানিয়েছেন, সে জন্য আপনাদের ধন্যবাদ জানাই’। তার পরেই উল্লেখ করেছেন, ‘অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের দেশের রাজনীতি ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অর্থ, ক্ষমতা আর দুর্নীতির জেরে উপেক্ষিত হচ্ছে জনস্বার্থ এবং নৈতিকতা, রাজনীতিতে নীতি-আদর্শ’।
তৃণমূল নেত্রীর এই ‘বার্তা’র পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেস নেতাদের একাংশ ‘ক্ষুব্ধ’। তাঁদের মতে, ‘মেকিয়াভেলিয়ান ম্যানিপুলেশনস’ বলে মমতা পরোক্ষে কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীকেই কটাক্ষ করতে চেয়েছেন। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য অবশ্য বলেন, “কার উদ্দেশে এই কথা কথা বলা হয়েছে, জানি না! তবে ফেসবুক দিয়ে তো আর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয় না!”
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে উদ্ভূত পরিস্থিতি-সহ রাজ্য-রাজনীতি নিয়ে আলোচনার জন্য আজ, সোমবার টাউন হলে মমতা দলীয় বিধায়ক ও সাংসদদের নিয়ে ‘জরুরি বৈঠকে’ বসবেন। তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর, সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে বিধানসভায় দলীয় বিধায়কদের কী করণীয় এবং তার পাশাপাশি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দলের কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করার কথা।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, রায়গঞ্জের কংগ্রেস সাংসদ দীপা দাসমুন্সি এ দিনই দাবি করেন, মমতা সমর্থন না-করলেও গোপন ব্যালটে ভোট হলে প্রণববাবু তৃণমূলের ৫০% ভোট পাবেন! পুরভোটে কংগ্রেসের জয় উদ্যাপন করতে এ দিন কুপার্স ক্যাম্পে কংগ্রেসের জনসভায় দীপা বলেছেন, “যে মানুষটা দীর্ঘ ৩৫ বছর বিভিন্ন দায়িত্বে থেকেছেন, তাঁকে নিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী যা করলেন, তা অনভিপ্রেত। উনি যা করছেন, তা মেনে নিতে পারছি না। কালাম রাষ্টপতি পদে দাঁড়াতে রাজি নন অথচ ফেসবুকে তাঁর নাম নিয়ে জনমত তৈরির চেষ্টা করছেন মুখ্যমন্ত্রী!” দীপার আরও বক্তব্য, “এত কিছুর পরেও প্রণববাবু কিন্তু ওঁকে ছোট বোন হিসেবে সম্বোধন করছেন।”
নদিয়ার জেলা কংগ্রেস সভাপতি তথা কুপার্সে জয়ের কাণ্ডারী শঙ্কর সিংহের বক্তব্য, “এক সময়ে সিপিএম আমাদের এখান থেকে সরাতে চেয়েছিল। আমাদের জোটসঙ্গীও তা-ই করেছে। তবে মানুষ ওদের প্রলোভনে পা দেননি। ওঁরা আমাদের সঙ্গেই আছেন।” দীপা-শঙ্করদের সঙ্গে মমতার সম্পর্ক অবশ্য জোট-রাজনীতিতে বরাবরই ‘মধুর’। তাই তাঁদের এ দিনের বক্তব্য অভিনব নয় বলেই মনে করা হচ্ছে। |