প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সুকৌশলে পাল্টা প্রার্থী দাঁড় করাতে গিয়ে বিজেপি এখন নিজেই বিপাকে।
রাষ্ট্রপতি ভোটের প্রার্থী বাছাই নিয়ে লালকৃষ্ণ আডবাণীর বাসভবনে এনডিএ-র দ্বিতীয় বৈঠকে নীতীশ কুমার এবং বাল ঠাকরের আপত্তি তো বটেই, বিজেপি-র অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্যও প্রকাশ্যে চলে এল। আর তার জেরেই আজও কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না জোট নেতৃত্ব। সন্ধ্যায় আডবাণী ফোন করলে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে জানিয়ে দেন, প্রণববাবুকেই সমর্থন করবে তাঁর দল। এই সিদ্ধান্ত থেকে তাঁরা কোনও ভাবেই সরছেন না। নীতীশের অনমনীয় অবস্থান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে দিল। এনডিএ বৈঠকে আজ শিবসেনা গরহাজির ছিল। তারাও কিন্তু প্রণববাবুকেই সমর্থনের পক্ষে। শুধু এনডিএ-র শরিকরা নয়, আজকের বৈঠকে বেশ কিছু শীর্ষ বিজেপি নেতাও প্রশ্ন তোলেন, “প্রধান বিরোধী দল হয়েও আমরা কেন নিজেরা প্রার্থী দেব না? কংগ্রেস কবে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করবে, তার জন্য কেন গালে হাত দিয়ে বসে রইলাম? এখন কেন অন্যের প্রার্থীকে সমর্থন করতে যাব?” প্রায় দু’ঘণ্টার এই উত্তাল আলোচনায় শেষ পর্যন্ত আডবাণী প্রস্তাব দেন, এনডিএ-শাসিত রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে মিলে জয়ললিতা, নবীন পট্টনায়ক ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অ-এনডিএ মুখ্যমন্ত্রী যদি একযোগে পূর্ণ সাংমার নাম প্রস্তাব করেন, তা হলে সব দিক সমাধা হয়। সকলে মিলে তাঁর সমর্থনে নামতেও পারেন। |
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই প্রস্তাবে শুধু নীতীশ নন, মমতাও রাজি হবেন কি না, তা এখনও অনিশ্চিত। মমতা এখনও বলছেন, তাঁর প্রার্থী কালাম-ই। সাংমার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক মধুর নয়। কারণ সাংমা এক সময় তৃণমূল ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। আবার বিজেপির সব মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে (যেখানে নরেন্দ্র মোদীও থাকবেন) মমতা একযোগে প্রস্তাব করবেন কি না, তা-ও বড় প্রশ্ন। সাংমাকে সমর্থন না করলে মমতাকে ‘একলা চলো’র নীতিই নিতে হবে। শেষ পর্যন্ত ভোটাভুটি হলে দলের সাংসদ-বিধায়কদের নির্দেশ দিতে হবে, তাঁরা যেন প্রণববাবুর বিরুদ্ধে ভোট দেন। কিন্তু সেখানেও মমতার চিন্তা থাকছে। কারণ দলীয় সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদী, কবীর সুমন তো বটেই, দলের বিধায়কদের একটা অংশও যে প্রণববাবুর পক্ষে ‘ক্রস-ভোট’ করতে পারেন, সেই আশঙ্কাও উড়িয়ে দিতে পারছে না তৃণমূল শিবির।
এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীও কিন্তু মমতাকে হারাতে চাইছেন না। বরং তাঁর ইচ্ছে, মমতা, মুলায়ম দু’জনই থাকুন ইউপিএ-তে। তাই মমতার সঙ্গে প্রণববাবুর ‘ইগো’র সংঘাত কমাতে সক্রিয় কংগ্রেস হাইকম্যান্ড। প্রধানমন্ত্রীও বিদেশ যাওয়ার আগে প্রণববাবুর সঙ্গে কথা বলেছেন। রাষ্ট্রপতি পদের জন্য মনোনয়ন পেশের আগে অর্থমন্ত্রী হিসেবে ইস্তফা দিতে হবে প্রণববাবুকে। তার আগে পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক সাহায্যের বিষয়টি নিয়ে যাতে প্রণববাবু সক্রিয় হন, সে পরামর্শও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এমনকী, কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিংহ আজ যে সাক্ষাৎকারে মমতার বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন, সেখানেও তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তাঁরা মমতাকে ইউপিএ ছাড়তে বলছেন না বা ‘বহিষ্কার’ও করছেন না। বরং মমতা কী করবেন, সেটা এখন তাঁর উপরেই ছেড়ে দিচ্ছেন।
বিরোধী শিবিরে আবার প্রণবকে সমর্থনের প্রশ্নে এর মধ্যেই আডবাণী-সুষমা স্বরাজ বনাম রাজনাথ-মুরলী মনোহর-যশবন্ত মতের লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রণবকে সর্বসম্মত প্রার্থী করার কথা প্রথম তুলেছিল বিজেপি-ই। তাই এই মতভেদ অসম্ভব নয় বলেই রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকের ধারণা। আডবাণীর মতো যাঁরা লড়াইয়ের পক্ষে, তাঁরা কেউ কেউ এখনও মুলায়মের উপরে ভরসা রাখছেন। মনে করছেন, সপা প্রধান যেমন মমতার বিশ্বাস ভেঙে প্রণবকে সমর্থন করেছেন, তেমনই ভোটাভুটির সময় ‘ক্রস ভোট’ করে ‘ভারসাম্য’ বজায় রাখবেন। আবার রাজনাথ-যশবন্তদের সুরে প্রণবের পক্ষে সমর্থনের হাওয়া ক্রমেই বাড়ছে। এই দলের মত, গত বার যেমন ভৈরোঁ সিংহ শেখাওয়াতের মন রাখতে শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ে নামে
বিজেপি এবং হেরে যায়, এ বার তেমনটা হলে তা দলের পক্ষে মোটেও ভাল হবে না। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে কর্মীদের মনোবল বাড়ানোর বদলে তা বরং উল্টো প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ, হেরে যাওয়া দলের নেতাদের কথা কেউ শুনতে চায় না।
শুধু রাজনাথরাই নন, সি পি ঠাকুর থেকে শত্রুঘ্ন সিনহার মতো বিজেপি নেতারাও এখন প্রকাশ্যেই প্রণববাবুর সমর্থন করতে শুরু করেছেন। এই অংশের মতে, নিছক বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করা উচিত নয়। বরং এখনও প্রণববাবুকে সমর্থন করে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে যশোবন্ত সিংহ, শরদ যাদব কিংবা নাজমা হেপতুল্লার মতো কাউকে উপরাষ্ট্রপতি পদে জেতানোর চেষ্টাও করা যেতে পারে। এমনকী, শরিক অকালি দলের প্রধান প্রকাশ সিংহ বাদলেরও মত, সংখ্যা না থাকলে আলাদা লড়ে লাভ নেই। সে কথা তিনি আডবাণীকে জানিয়েওছেন। ফলে এখন যা পরিস্থিতি তাতে নির্বাচন একটা হতে পারে। কিন্তু কার্যত নির্বাচনের দৌড়ে প্রণববাবুই অনেকটা এগিয়ে। বলা যেতে পারে, যদি এই পরিস্থিতিই বহাল থাকে, তা হলে প্রণববাবুই যে রাইসিনা হিলে পদার্পণ করছেন, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
আডবাণী তবু হাল ছাড়েননি। শেষ মুহূর্তে নীতীশ, বাদলকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে এটাই ইউপিএ-কে ভাঙানোর বড় সুযোগ। এনডিএ-র বিস্তারটাও জোটের লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাই এখন এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে, যাতে মমতা ইউপিএ থেকে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু এ ব্যাপারেও নীতীশের একটা পাল্টা যুক্তি আছে। তিনি বলছেন, মমতা যদি এনডিএ-তে আসেন তবে এমনিই আসবেন। সে জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়ে আসতে হবে কেন? নিজের অবস্থানের পক্ষেও নীতীশ জানিয়েছেন, প্রতিভা পাটিলকেও শিবসেনা ভোট দিয়েছিল। তখন তো কেউ বলেননি, তাঁকে এনডিএ থেকে বের করে দেওয়া হবে! এনডিএ-র মধ্যেও প্রত্যেক শরিকের নিজ নিজ মতামত থাকে, এনডিএ তাকে মেনেও নেয়। এ ক্ষেত্রে জেডি(ইউ) প্রণববাবুকে সমর্থন করলে এনডিএ কেন তা মেনে নেবে না?
আরএসএস নেতারা আবার কালামের ব্যাপারে যতটা না আগ্রহী ছিলেন, সাংমার ব্যাপারে ততটা কি না সন্দেহ। খোদ সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, কালামই শ্রেষ্ঠ প্রার্থী। সাংমা উপজাতি ও খ্রিস্টান নেতা। সম্প্রতি গোয়ার বিধানসভা নির্বাচনে খ্রিস্টান বিধায়করা বিজেপির টিকিটে জিতে আসার পর নিতিন গডকড়ীরা সংখ্যালঘুদের মন জয় করার কৃতিত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু বিজেপি, বিশেষ করে আরএসএস নেতৃত্ব মুখে যা-ই বলুন, এক জন খ্রিস্টান প্রার্থীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে কতটা মেনে নেবেন, সেই প্রশ্নটাও থেকে যাচ্ছে। গডকড়ী নিজেও সাংমাকে প্রার্থী করতে কতটা উৎসাহী, বিজেপির মধ্যে অনেকেই সেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন। গডকড়ীর বক্তব্য, বিজেপির প্রার্থী হলে না হয় এক কথা। বাইরের কোনও প্রার্থীকে সমর্থন কতটা করা উচিত, তা নিয়ে পর্যালোচনা প্রয়োজন। উল্টো দিকে আডবাণীর বক্তব্য, কালাম প্রার্থী হতে না চাইলে সাংমার নামেই লড়াই করা সম্ভব। আশা করা হচ্ছে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এই ছবিটা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
|