আগাছার জঙ্গল পেরিয়ে চুনকাম খসে পড়া জীর্ণ দোতলা বাড়ি। উঠোন পেরোলেই স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার ঘর।
তারও থেকে গাঢ় অন্ধকার ওই ঘরের বাসিন্দা দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার জীবনে। মেঝেতে এক-পাহাড় কাগজের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে অন্ধকার হাতড়েই চিঠিগুলো বার করে আনলেন ৬৭ বছরের বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে লেখা চিঠি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখা চিঠি। আবেদন-নিবেদনে ভরা সেই সব চিঠির কিছু উত্তরও রয়েছে কাগজ-স্তূপের মধ্যে। কিন্তু জবাবি চিঠিতেও নিখোঁজ নীলুর কোনও খবর নেই।
নীলু। বিশ্বনাথ-ভগবতীর একমাত্র ছেলে। ২৬ বছরের ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়। ৬৫৯ দিন পরেও নীলুর কোনও হদিস দিতে পারেননি কেউ।
২০১০ সালের ২৭ অগস্ট আচমকাই উধাও হয়ে যান ইন্দ্রনীল। তখন তাঁর বয়স ছিল কমবেশি ২৪ বছর। সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে তখন সবে আইনে স্নাতক হয়েছেন তিনি। ঘটনার দিন বিকেলে বন্ধুর ফোন পেয়ে বেরিয়ে যান। সন্ধ্যায় বিশ্বনাথবাবু ফোন করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “রাতে কী খাবি?” ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে বাড়ি ফিরে
|
নিখোঁজ ইন্দ্রনীল |
ডিমের ঝোল-ভাত খাওয়ার কথা ছিল নীলুর। কিন্তু আজও ফেরা হয়নি তাঁর।
বেসরকারি সংস্থা থেকে অবসর নেওয়া বিশ্বনাথবাবুর কথাবার্তায় আজ যেন কোথাও কোথাও সঙ্গতির ঈষৎ অভাব! বলেন, “পির-ফকিরের থান, তারাপীঠ অনেক ঘুরেছি। সকলেই বলেছে, নীলু বেঁচে আছে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে কেন যোগাযোগ করে না, কে জানে!” নীলুর অন্তর্ধানের পরে দমদম থানা তদন্তে নেমেছিল। খোঁজ পায়নি। বন্ধুরা হাসপাতাল, মর্গ ঘুরেও নীলুর হদিস পাননি। তদন্তকারী অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গিয়েছে, হাওড়ার বালির কাছে শেষ বার নীলুর মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন পাওয়া গিয়েছিল। তার পর থেকে সেই মুঠোফোনও বন্ধ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নিজেদের মতো করে নীলুর নিখোঁজের কারণ খোঁজার চেষ্টা চালিয়েছেন। চালিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর। চরম আশঙ্কার কথাও জেগেছে মা-বাবার মনে। নীলু কি খুন হয়েছেন। হয়ে থাকলে খুনের কারণ কী? পুলিশে কর্মরত এক মহিলার সঙ্গে নীলুর এক সময়কার ঘনিষ্ঠতাই কি সেই কারণ? নাকি রানাঘাটের পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে বিবাদেই প্রাণ দিতে হয়েছে তাঁকে?
তদন্তকারীদের মতে, স্রেফ ওই দু’টি কারণের জন্য হত্যার মতো বড় ঘটনা ঘটতে পারে না। খুনের তেমন কোনও যুক্তিও খুঁজে পাচ্ছেন না তাঁরা। তা হলে কী হল নীলুর? বৃদ্ধকে অবাক করে দিয়ে সম্প্রতি সিআইডি থেকে একটি চিঠি পাঠিয়ে জানানো হয়েছে, তদন্ত করে কূলকিনারা পাননি গোয়েন্দারাও।
কী বলছেন বন্ধুরা?
নীলুর কলেজের সহপাঠিনী সায়ন্তনী সাহা। তিনি বললেন, “দিদির বিয়ের পর থেকেই খানিকটা মুষড়ে পড়েছিল ইন্দ্রনীল। দিদির উপরে অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল তো।” কিন্তু আচমকা উধাও হয়ে যাওয়ার পিছনে সেটা যে কোনও কারণ হতে পারে না, সায়ন্তনীও সেটা বিলক্ষণ জানেন। কবিতা লিখতেন, পাহাড়ে বেড়াতে যেতে ভালবাসতেন ইন্দ্রনীল। মায়ের চিকিৎসা নিয়ে চিন্তায় থাকতেন। অন্য এক সহপাঠী তনয় ভট্টাচার্য জানান, ইন্দ্রনীল কখনও অসৎসঙ্গে পড়েছিলেন বলে শোনেননি তিনি।
ছোটবেলা থেকে ইন্দ্রনীলের সঙ্গে খেলাধুলা করতেন অভিজিৎ দাশগুপ্ত। তাঁর কথায়, “ছোটবেলা থেকে ওকে দেখেছি। ওর কোনও শত্রু ছিল না। সকলের সঙ্গে ভাল ভাবে মেলামেশা করত। নীলু উধাও হয়ে যাওয়ার পরে আমরা খুব খোঁজাখুঁজি করেছি।”
রাস্তাঘাটে এখনও অভিজিৎদের সঙ্গে দেখা হয় বিশ্বনাথবাবুর। অভিজিতেরা কিছু বলার আগেই বৃদ্ধ তাঁদের আশ্বাস দেন, “নীলু ফিরে আসবে, দেখো। ফিরে আসবেই। ছাই রঙের জিনস, সবুজ রঙের টি-শার্ট আর কেডস পরে।”
নীললোহিতের নীলু দিকশূন্যপুর খুঁজে বেড়ায়। আবার ফিরেও আসে। বারবার। নিজের নীলুর ফেরার পথ চেয়ে বিশ্বাসে স্থির আছেন বৃদ্ধ বিশ্বনাথ। |