ক্লাস নিলেন বিরু সহস্রবুদ্ধে ওরফে ভাইরাস।
‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবির সেই গুরুগম্ভীর প্রিন্সিপাল অতিষ্ঠ হয়ে তিন বেচারা ছাত্র যাঁকে জ্যান্ত গরম তেলে ভাজার খোয়াব দেখেছিল। রবিবারের সন্ধ্যায় নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে সেই ভাইরাসের ক্লাস অবশ্য ছিটেফোঁটা গাম্ভীর্যের ধার মাড়াল না। বরং উচ্ছ্বাসে পাশেই ইডেন গার্ডেনের গ্যালারির সঙ্গে পাল্লা দিল ইন্ডোরের জনতা।
আনন্দবাজার পত্রিকার আয়োজনে পৈলান গ্রুপের ‘এডুকোয়েস্ট’-এর আসরের অতিথি হিসেবে হাজির বোমান ইরানি অবশ্য এটাই চেয়েছিলেন। ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’-এর ডক্টর আস্থান্না বরং শেষটায় তাঁর মুগ্ধ শ্রোতাদের অকাতরে ‘জাদু কি ঝাপ্পি’ বিলোতেই ক্লান্ত হয়ে পড়লেন।
মুম্বইয়ের ফুটপাথে হাতে গরম ছ্যাঁকা খেয়েও মেয়েদের সামনে দারুণ ‘স্মার্ট’ কসরতে চিপ্স, নিমকি ভাজতেন যে তরুণ, দু’দশক বাদে রুপোলি পর্দায় তাঁর উত্থানই তো হতে পারে এক অবিশ্বাস্য হিট ছবির চিত্রনাট্য।
পাঁচতারা হোটেলে ওয়েটারগিরিও করেছেন। মুম্বইয়ের ময়দানে মোটে ২০ টাকায় হ্যারিস শিল্ডের খুদে ক্রিকেটারদের ছবি তুলতেন যে অখ্যাত আলোকচিত্রী, তিনি আজ বলিউডের সব থেকে দামি চরিত্রাভিনেতা। অনেকেই জানেন না, টালিগঞ্জের চূর্ণি গঙ্গোপাধ্যায়, রাজেশ শর্মাদের মতো অভিনেতাদের ছবির পোর্টফোলিও-ও একদা বোমানই ক্যামেরা-বন্দি করেছিলেন।
নেতাজি ইন্ডোরে এই বোমান ইরানির সান্নিধ্যে ঘণ্টা দেড়েকে কী পেল কলকাতার উৎসুক তরুণ প্রজন্ম?
মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তারা শুনল, নিজের জীবনের সব সীমাবদ্ধতাকেই ‘অ্যাডভান্টেজে’ রূপান্তরের আখ্যান। ‘তারে জমিন পর’-এর ঈশানের মতো বোমানেরও ডিসলেক্সিয়া-র সমস্যা ছিল। অঙ্ক কাবু করত তাঁকে। ছোটবেলায় জিভের আড়ষ্টতায় ‘হর্স’ বা ‘হিপোপটেমাস’ উচ্চারণ করতে না-পেরে স্কুলে ‘অ্যাডমিশন’ও কেঁচে গিয়েছিল। তখন কে জানত, পরে নিজের সেই উচ্চারণের মুদ্রাদোষকে ব্যবহার করেই ‘ভাইরাস’-এর চরিত্রে মাত্রা জুড়বেন তিনি।
এ দিন তাই এক অন্য মাস্টারমশাইকে দেখল জনতা। পড়ুয়া ও অভিভাবক নির্বিশেষে সবাইকে যিনি বললেন, আরে ভাই, ভাল নম্বর পেলে ভাল, নয়তো নিজের খারাপ নম্বর নিয়েই তো উৎসব করা যায়! “আমার ছেলেরা স্কুলের পরীক্ষায় ৪৫% পেলেই আমরা হইচই করতাম”--- সহাস্য মন্তব্য বোমানের। |
নেহাতই মুখের কথা নয়, জীবনের ব্যর্থতার এই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এক-একটি মুহূর্তই যে আসলে ঘুরে দাঁড়ানো বা জীবনের চিত্রনাট্যে মোড় ঘোরানোর মাহেন্দ্র ক্ষণ, সেটাও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনল ‘ভাইরাস জ্বরে’ কাহিল কলকাতার জনতা।
টাইম-মেশিনে চড়ে বোমানের ৩২ বছর বয়সের একটি দৃশ্যের সামনে যেন থমকে দাঁড়িয়েছিল কলকাতা। বোমানের কথায়, “এটা আমার জীবনের জিরো বাল্ব মোমেন্ট।”
নিম্নবিত্ত খেপ-খাটা আলোকচিত্রী বা ফুটপাথের নিমকি ভাজার শিল্পী সে-বার জীবনে প্রথম বৌ-বাচ্চাদের নিয়ে উটিতে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন। পকেটের দৌড় অনুযায়ী, যে হোটেলে ঢুকেছিলেন তার ঘরে জ্বলবার মতো বাতিটাও ছিল না। নিজের কাছের মানুষদের হয়রান হতে দেখার গ্লানির মুহূর্তটাই পাল্টে দিয়েছিল লোকটাকে। ঘরের চেয়ারের উপরে উঠে দাঁড়িয়ে চোয়াল শক্ত করে যে ঘোষণা করবে, “দেখো, আমি এক দিন সেরা ফটোগ্রাফার হবই।”
বোমানের জীবনের বিচিত্র চড়াই-উতরাইয়ের মজাটা এখানেই। ৩২ বছর বয়সে জীবনে কিছু করার জেদ চেপে ধরলেও তখনও পর্যন্ত অভিনেতা হওয়ার ভাবনাটা তাঁর স্বপ্নেও জায়গা পায়নি। ছোটবেলা থেকে গোগ্রাসে সিনেমা গিলে নিজের মনে তা নিয়ে লেখালেখি করে গেলেও মুখচোরা তোতলা ছেলে কখনও ভাবেননি তিনি অভিনেতা হতে পারবেন। এক বন্ধুর তাড়নায় থিয়েটার করতে গেলে নাটককার অ্যালেক পদমসিও প্রথম দেখায় বোমানের মধ্যে বিস্ময়কর প্রতিভা দেখেননি।
এর পরে বোমানের জীবনটা পাল্টে দিল, বন্ধু রাম মাধবানির ছবি ‘লেট্স টক’। ওই ছবিতে বোমানকে দেখেই তাঁর ভবিষ্যতের ছবির জন্য চেক সই করে দিয়েছিলেন বিধুবিনোদ চোপড়া। যে ছবির চিত্রনাট্যও পর্যন্ত তখনও ঠিক হয়নি। সেই ছবিটাই পরে অবশ্য ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’। ডক্টর আস্থানার চরিত্রে অভিনয়ের জন্য রীতিমতো ঝুলোঝুলি করে তাঁর কাছে ১৪টা দিন চেয়ে নিয়েছিলেন বিধুবিনোদ।
তখনও ফটোগ্রাফার হওয়াই ছিল বোমানের জীবনের লক্ষ্য। কিন্তু এত লোকে অনুরোধ করছে বলে রোলটা করতে রাজি হয়ে যান তিনি। বোমান বলছিলেন, “ভাগ্যিস হয়েছিলাম! এখন বুঝতে পারি, যারা ভাল চায় বা ভালবাসে তাদের কথাও শুনতে হয়। দুনিয়াটা কড়া জায়গা, কিন্তু আসলে খারাপ নয়।”
মুন্নাভাইয়ের মুক্তির দু’দিনের মধ্যে মুম্বইয়ের এক খঞ্জ ভিখারির মুখে ‘মামু’ ডাক শুনে সিনেমার ক্ষমতা কতটা, সেটা বুঝেছিলেন বোমান। তার পর থেকে সিনেমাই তাঁর সঙ্গী।
শুধু অভিনয়ে আসার লড়াই নয়, অভিনয়-জীবনের ঘাম-রক্ত ঝরানোর কথাও এ দিন শুনিয়েছেন উৎপল দত্তের অন্ধ ভক্তটি। ‘লাগে রহো মুন্নাভাই’-এর লাকি সিংহ হতে কী ভাবে দিনের পর দিন ‘সর্দারজি’দের সঙ্গে মেলামেশা করতেন বা ‘ভাইরাস’-এর রাশভারী শরীরী ভাষা রপ্ত করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আইআইএম বেঙ্গালুরুর ক্যাম্পাসে পড়ে থাকতেন, সে-সব টুকরো কাহিনি।
যা-ই কর, প্রাণ দিয়ে কর। আর পড়ে-পাওয়া চোদ্দো আনাকেও ফেলনা ভেব না এটাই বোমানের জীবন-দর্শন। সরস ভঙ্গিতে যিনি বলেছেন, “সুন্দরীদের বাবার রোল করি তো কী হয়েছে! সব থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াজড়িটা কিন্তু আমার বরাতেই জোটে।” শুনে হো হো করে হেসেছে কলকাতা!
ভাইরাসের বাণী, “লক্ষ্যের তোয়াক্কা কোরো না। জীবনটা আনন্দের জন্য। সফরটা বেশি জরুরি।” শুধু তরুণতররাই নয়, জীবনে পোড়-খাওয়াদের জন্যও এই সন্ধেটা এই জন্যেই স্মরণীয় হয়ে থাকল। |