নিজের নামে সরকারি বিপিএল রেশন কার্ড আছে। তবুও পুরসভার দেওয়া বার্ধক্য ভাতা পাচ্ছেন না টালিগঞ্জের সত্তরোর্ধ্ব সমরেশ মণ্ডল। কাউন্সিলরের কাছে জানতে পেরেছেন ওই কার্ডে কাজ হবে না। একই হাল বাইপাসের কাছে আনন্দপুরের বাসিন্দা সরস্বতী ঘোষেরও। বিধবা এই মহিলা খবর পেয়েছিলেন, বিপিএল কার্ড থাকলে মাসে ৪০০ টাকা করে ভাতা পাবেন। পুরসভা তাঁকেও ফিরিয়ে দিয়েছে। পুরসভার এক পদস্থ কর্তার কথায়, “ওঁদের আবেদন নিয়মমাফিক হয়নি। তাই ভাতা পাননি।”
নিয়মটা কী? পুরসভার সমাজকল্যাণ দফতরের অফিসারের বক্তব্য, “শুধু রেশন কার্ডে বিপিএল লেখা থাকলেই হবে না। পুরসভার নিজস্ব একটি তালিকা আছে। সেই তালিকায় নাম থাকলে তবেই মিলবে ভাতা।”
মহাকরণ সূত্রের খবর, ১৯৯৯ সালে রাজ্য সরকার বিপিএল চিহ্নিত রেশন কার্ড দেওয়া শুরু করে। ওই কার্ড দেখিয়েই বিপিএল তালিকাভুক্তরা সরকারি সুযোগসুবিধা পেয়ে থাকেন। তা হলে পুরসভার ওই ভাতা তাঁরা পাবেন না কেন? এ বিষয়ে পুরসভার ওই আধিকারিকের বক্তব্য, “২০০৬ সালের পর থেকে পুরসভা এই নিয়মেই চলছে। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।”
কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ রাজীব দেবও বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর সাফ কথা, “আবেদনকারীর কাছে যদি সরকার-স্বীকৃত বিপিএল কার্ড থাকে, তা হলে তাঁকে ওই ভাতা দেওয়া উচিত।” সিপিএমের কাউন্সিলর তথা পুরসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান দীপঙ্কর দে বলেন, “আমার ওয়ার্ডে অনেকেই ওই ভাতা পাওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। কিন্তু পুরসভার তালিকায় নাম না থাকায় পাননি।” যদিও পুরসভার দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র পারিষদ সঞ্চিতা মণ্ডলের বক্তব্য, “এ নিয়ম তো বাম বোর্ডের আমলেই করা হয়েছিল। সেটাই চলছে।”
ক্ষমতায় এসে আপনারা তা বদলাননি কেন? সঞ্চিতাদেবী আত্মসমালোচনার সুরে বলেন, “ওঁদের ভুল নিয়মটা দু’বছর ধরে আমরাও চালিয়ে যাচ্ছি। এটা ঠিক হচ্ছে না। তবু চলছে।” দক্ষিণ কলকাতার এক তৃণমূল কাউন্সিলরের কথায়, “পুরসভায় এক শ্রেণির আমলার ‘বেহিসেবি’ সিদ্ধান্তেই গত ২০১০ সাল থেকে কলকাতার হাজার হাজার বাসিন্দা বিধবা ও বার্ধক্য ভাতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ তাঁরা প্রকৃতই ভাতা পাওয়ার যোগ্য।”
পুরসভা সূত্রের খবর, খাদ্য দফতরের দেওয়া বিপিএল তালিকাভুক্তরা শুধু চাল-গম পান। ভাতা বা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কোনও সুবিধা পেতে হলে পুরসভার নির্দিষ্ট তালিকায় নাম থাকতে হবে।
কে বানায় ওই তালিকা? পুরসভা সূত্রের খবর, ২০০৬ সালে নগরোন্নয়ন দফতরের সংস্থা ‘স্টেট আরবান ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি’ (সুডা) কলকাতা-সহ রাজ্যের ১২৭টি পুরসভার জন্য ওই তালিকা তৈরি করে। পুরসভার এক অফিসার জানান, তাতে প্রায় এক লাখ ৯৭ হাজার জনের নাম ছিল। ওই তালিকা যাচাই করতে গিয়ে দেখা যায়, তালিকায় নাম থাকা অনেকের অস্তিত্বই নেই। কিছু নামের পাশে দেওয়া ঠিকানারও হদিস ছিল না। কিন্তু পুরসভার উপরতলার নির্দেশে সেই তালিকা ধরেই ভাতা দেওয়া হয়েছে।”
পুরসভা ২০০৯ সালে ফের ওই তালিকা নিয়ে সমীক্ষা শুরু করে। তাতে সংখ্যাটা কমে এক লক্ষ ৮৩ হাজারে দাঁড়ায়। সেই তালিকাও সঠিক নয় বলে দাবি একাধিক কাউন্সিলরের। তৃণমূল কাউন্সিলর সুশান্ত ঘোষ বলেন, “মাস খানেক আগে পুরসভার বিপিএল তালিকা ধরে মেডিক্লেম পলিসি করাতে গিয়ে দেখেছি অনেক নামের কোনও অস্তিত্বই নেই।” এ বিষয়ে পুরসভার সমাজকল্যাণ দফতরের এক অফিসারের বক্তব্য, “তালিকা করে দিয়েছে ‘সুডা’। ওঁরাই এর উত্তর দিতে পারবেন।”
আবার ‘সুডা’-র এক পদস্থ অফিসার বলেন, “আমরা শুধু ফর্মুলা করে দিই। তালিকা ওঁরাই করেন। এখন আমাদের উপরে দোষ চাপানো হচ্ছে।” খাদ্য দফতরের দেওয়া রেশন কার্ড (বিপিএল) দেখিয়ে পুরসভায় বার্ধক্য ও বিধবা ভাতা দেওয়ার বিষয়ে ওই অফিসারের মন্তব্য, “পুরসভা এ বিষয়ে কোনও প্রস্তাব দিলে তা দেখা হবে। ইতিমধ্যেই আমরা পুরসভাকে বলেছি অন্ত্যোদয় ও অন্নযোজনা প্রকল্পে থাকা মানুষজনকে ওই সুবিধা দেওয়া হোক।” সঞ্চিতাদেবী অবশ্য বলেন, “শীঘ্রই পুরসভা পুরনো নিয়ম থেকে বেরিয়ে নতুন নিয়ম চালু করবে।” |