বয়স বছর দশ। তবু নিজের কোনও কাজই নিজে করতে পারে না আরিয়ান। স্নান-খাওয়া, এমনকী জামাকাপড় পরতেও সাহায্য লাগে অন্যের। দু’টো হাত অক্ষতই। তবু সেই হাতে কোনও কিছু ধরতে পারে না, উপরে সোজা করে তুলতে পারে না। পা-টাও টেনে চলে। অথচ, সাত বছর আগে আর পাঁচটা বাচ্চার মতোই বড় হচ্ছিল বছর তিনেকের ছোট্ট আরিয়ান। এক দিন হঠাৎ তার মায়ের নজরে পড়ে, পিঠে ব্যাগ নিতে সমস্যা হচ্ছে ছেলের। চিকিৎসকদের কাছে নিয়ে যাওয়ার পরে প্রথমে জানা যায়, আরিয়ানের ‘মাইট্রাল ভাল্ভ থিকেন্ড’। অর্থাৎ, হৃদ্যন্ত্রের ‘মাইট্রাল’ ভাল্ভের উপরে কিছু জমে জমে ক্রমশ মোটা হয়ে যাচ্ছে সেই ভাল্ভ। আর এর কারণ হিসেবেই বেরিয়ে আসে ‘মিউকোপলিস্যাকারাইডোসিস-২’ (এমপিএস-২) নামে এক বিরল রোগের নাম।
প্রথমটায় এ কথা বিশ্বাস হয়নি আরিয়ানের বাবা-মা, হাওড়ার মন্দিরতলার শিবশঙ্কর ও দেবযানী চৌধুরীর। অবশেষে ভেলোর ও দিল্লির বেসরকারি হাসপাতাল থেকে তাঁরা জানতে পারেন, এমপিএস ২-এর ‘হান্টার সিনড্রোম’-এর শিকার তাঁদের ছেলে। |
মা-বাবার সঙ্গে আরিয়ান। — নিজস্ব চিত্র। |
কী এই ‘হান্টার সিনড্রোম’? বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, কোষের মধ্যে থাকা লাইসোজোম বিভিন্ন পাচক রসের সাহায্যে খাদ্য থেকে বর্জ্য বস্তুকে কোষের বাইরে বার করে দেয়। কোনও পাচক রসের অভাব ঘটলে বা তুলনায় কম ক্ষরণ হলে লাইসোজোম নিজের কাজ করতে পারে না। তখনই সমস্যা দেখা দেয়। একে বলে ‘লাইসোজোম স্টোরেজ ডিজ-অর্ডার’ বা এলএসডি। শরীরের বিভিন্ন কোষে ওই সব বর্জ্য জমা হতে হতে ফুলে ওঠে শরীরের বিভিন্ন জায়গা। প্রথমে ভ্রূ-তে পরিবর্তন দেখা যায়। ঘাড় ছোট হয়ে যায়। মাংসপেশি শক্ত হয়ে গিয়ে পেশি সঞ্চালন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। এ ভাবে শিশুর শরীরেও রোগের নির্দিষ্ট গড়ন চলে আসে। ৫০ রকমের এলএসডি-র একটি জিনঘটিত এই ‘হান্টার সিনড্রোম’। এ ক্ষেত্রে দায়ী ‘আলফা আইডুরনেট সালফেট’ নামের পাচক রসের তারতম্য। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, মা অথবা বাবার জিনের মাধ্যমে নবজাতকের শরীরে প্রবেশ করে এই অসুখ। তবে ‘হান্টার সিনড্রোম’ শুধু ছেলেদেরই হয়। জন্মের পরে বাচ্চা সুস্থ থাকলেও ধীরে ধীরে কোষের মধ্যে বর্জ্য ‘মিউকোপলিস্যাকারাইড’ জমতে থাকার কারণে প্রকাশ পায় রোগের লক্ষণ।
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, মাত্র পাঁচটি এলএসডি-র ক্ষেত্রে ‘এনজাইম থেরাপি’ সম্ভব। সারা পৃথিবীতে মাত্র দু’টি ওষুধ নির্মাণ সংস্থা এই রোগগুলির জন্য ইন্ট্রাভেনাস ইঞ্জেকশন তৈরি করে। হান্টার সিনড্রোমের জন্য জরুরি ইঞ্জেকশন ‘ইলাপ্রেস’ তৈরি করে ‘সায়ার’ নামের এক ওষুধ সংস্থা। এ দেশে তাদের ওষুধ বিক্রির অনুমতি নেই। ফলে রোগীর পরিবারকে বিদেশ থেকে ওষুধ আনাতে হবে। শিশু চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষের কথায়, “এই রোগের বিষয়ে সচেতনতা খুুব কম। একমাত্র চিকিৎসা, প্রতি সপ্তাহে একটি করে ইন্ট্রাভেনাস ইঞ্জেকশন। আরিয়ানের স্নায়ুতে এখনও এই রোগের প্রভাব পড়েনি। তাই নিয়মিত ইঞ্জেকশন নিলে ওর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা অনেকটা কাটবে। তবে আরিয়ানের পরিবারের পক্ষে ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা চালানো অসম্ভব। তাই বিনা চিকিৎসাতেই রয়েছে ছেলেটি।”
স্বাস্থ্য দফতরের পাওয়া তথ্যে পশ্চিমবঙ্গে বিরল এই রোগের শিকার মাত্র তিন জন। সম্প্রতি এক জন মারা গিয়েছে। আক্রান্ত আর এক জন বেহালার বাসিন্দা দশ বছরের একটি শিশু।
এসএসকেএমের মেডিক্যাল জেনেটিক্সের সহকারী অধ্যাপক কৌশিক মণ্ডলের মতে, “মাসে চার লক্ষ টাকারও বেশি খরচ এই চিকিৎসায়। বিমা ছাড়া এই দীর্ঘমেয়াদি খরচ মধ্যবিত্তের পক্ষে বহন করা কার্যত অসম্ভব। এ দেশে জিনঘটিত অসুখের জন্য বিমা হয় না। এই অসুখ বিমার তালিকাভুক্ত করতে সরকারকে আইন প্রণয়ন করতে হবে।” শিবশঙ্করবাবু তাঁর ছেলের চিকিৎসার জন্য সরকারি স্তরে আবেদন করেছেন।
‘ডোরেমন’ আর ‘ছোটা ভীম’-এর ভক্ত আরিয়ান অবশ্য অবসর সময়ে দুই আঙুলের ফাঁকে কাঠি চেপে ড্রামও বাজায়। পুজো-আর্চাতেও তার বেশ মন। সব প্রতিবন্ধকতা নিয়েও ছবির বইয়ের পাতা লাল-নীল রঙে ভরিয়ে বেশ আনন্দেই থাকে সে। |