|
|
|
|
বিপত্তি মোবাইলে |
একজনের নথিতে অন্যকে ‘সিম’ |
বরুণ দে • মেদিনীপুর |
শহর-শহরতলিতে এখন মোবাইল সিম-কার্ডের খুচরো বিক্রেতার ছড়াছড়ি। অনেক জায়গায় প্রয়োজনীয় নথিপত্র ছাড়াই সিম-কার্ড বিক্রি হচ্ছে বলেও অভিযোগ। এর ফলে সমস্যায় পড়ছেন গ্রাহকরাই। সম্প্রতি, পুলিশে চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা তোলার ঘটনায় একটি প্রতারণা-চক্রের হদিস পায় সিআইডি। চক্রে জড়িত-সন্দেহে বাসুদেব সিংহ নামে ঝাড়গ্রাম জেলা পুলিশের এক এএসআই-ও গ্রেফতার হয়েছেন। এখন রয়েছেন জেল হেফাজতে। তদন্তে সিআইডি জানতে পারে, বাসুদেব ৪টি মোবাইল-সিম ব্যবহার করতেন। এর মধ্যে ২টি উপযুক্ত নথিপত্র দিয়ে নিজের নামে কেনা। অন্য ২টি কেনা হয়েছিল উপযুক্ত নথিপত্র ছাড়াই। একটি সিম কেনা হয়েছিল ডেবরার এক যুবকের নামে। অন্যটি মেদিনীপুরের এক যুবকের নামে। জঙ্গলমহলে পুলিশের জুনিয়র কনস্টেবল-পদের মৌখিক পরীক্ষার ফল এই দুই ‘সিম’ ব্যবহার করেই মোবাইলে বাসুদেব প্রতারণা-চক্রের অন্যদের জানিয়েছিলেন বলে দাবি সিআইডি-র। যার সূত্রেই ওই চক্রের লোকজন চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নামে আগ্রহী প্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা তুলছিল বলে অভিযোগ।
তদন্তের প্রয়োজনে ডেবরা ও মেদিনীপুর শহরের সেই দুই যুবককেও (যাঁদের নামে সিম ব্যবহার করছিলেন বাসুদেব) জেরা করেছিল সিআইডি। জেরায় গোয়েন্দারা নিশ্চিত হন, ওই দুই যুবক এ ক্ষেত্রে নিরপরাধ। তাঁরা এক সময়ে নিজেদের পরিচয়-সংক্রান্ত উপযুক্ত নথিপত্র দিয়ে সিম-কার্ড কিনেছিলেন। সেই সিম তাঁরা ব্যবহারও করেন। কিন্তু তাঁদের জমা দেওয়া নথি সিম-কার্ডের কারবারিরা ব্যবহার করেছেন অন্যকে অন্য ‘সিম’ বিক্রির সময়েও। ওই দুই যুবক জানতেনই না এমনটা হয়েছে। তাঁদের অজ্ঞাতসারেই তাঁদের নামে কেনা সিম ব্যবহার করছিলেন ঝাড়গ্রামের পুলিশকর্মী বাসুদেব। এবং তা ব্যবহার হচ্ছিল অপরাধের উদ্দেশ্যে। সিআইডি অফিসারদের কাছে থেকে ব্যাপারটা জেনে ডেবরা-মেদিনীপুরের ওই দুই যুবকের তো চক্ষু চড়কগাছ। জেলায় সিমের কারবারিরা যে এ ভাবে গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে যা-নয় তাই করছেন, ওই দুই যুবকের সঙ্গে সঙ্গেই তা স্পষ্ট হয় গোয়েন্দাদের কাছেও।
বিষয়টি জানাজানির পর ওই দুই যুবকের মতোই অন্য গ্রাহকরাও শঙ্কিত। আচমকা বিপদে পড়ার ভয় পাচ্ছেন। গ্রাহকদের বক্তব্য, শহর-শহরতলিতে সিম-কার্ডের কারবারে কোনও নজরদারিই নেই। সার্ভিস-প্রোভাইডার সংস্থাগুলির (যাদের সিম) ভূমিকা নিয়েও তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন। যেখানে মাঝেমধ্যেই ওই সব সংস্থার এক্সিকিউটিভ ফোন করে প্রিপেড থেকে পোস্টপেড করা বা অন্য নানা ‘অফার’ নিয়ে তদ্বির করেন, উপযুক্ত নথি না-জমা দিয়ে থাকলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার হুঁশিয়ারিও দেনসেখানে সংস্থার রেকর্ডে যে নামে ‘সিম’ কেনার নথি রয়েছে, সেই ব্যক্তিই সিমটি ব্যবহার করছেন কি না, সেটুকু কেন যাচাই করা হবে নাসেই প্রশ্ন উঠেছে। নথি-র মধ্যে সাধারণত ‘এপিকে’র (সচিত্র ভোটার-পরিচয়পত্র) প্রতিলিপি নেওয়া হয়েই থাকে। এপিকে প্রত্যেক ভোটারের আইডেন্টিটি নম্বর স্বতন্ত্র। ফলে সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব, নথি-র অপব্যবহার হচ্ছে কি না। কিন্তু না প্রশাসনিক, না সংস্থাগতকোনও নজরদারি ছাড়াই চলছে মোবাইল-বাণিজ্য। নজরদারির এই অভাবকে কাজে লাগিয়েই একজনের নথিতে অন্যকে ‘সিম’ বেচছেন সিম-কার্ডের খুচরো ব্যবসায়ীরা। বিপদ বাড়ছে গ্রাহকদের।
ওই ব্যবসায়ীরা আগেই কেনা সিমের জন্য কোনও গ্রাহকের জমা দেওয়া নথি অন্য কোনও গ্রাহকের জন্যও ব্যবহার করছেন। বিষয়টি যে উদ্বেগজনক, তা মানছে পুলিশও। পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার সুনীল চৌধুরি বলেন, “প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া সিম-কার্ড বিক্রি হতে পারে না। কী ভাবে এটা হচ্ছে, তা দেখা হবে। প্রয়োজনে শহর ও শহরতলিতে তল্লাশি শুরু হবে।” তরুণ-তরুণীরা প্রায়ই খুচরো বিক্রেতাদের কাছ থেকে নিত্য-নতুন সিম কেনেন। এর ফলেও এক জনের জমা দেওয়া নথি পরে অন্যের ক্ষেত্রে ব্যবহারের সুযোগ বাড়ছে ব্যবসায়ীদের। এক যুবকের কথায়, “এখন তো ২০ টাকা দিলেই নতুন সিম পাওয়া যায়। অনেক সময়ে কাগজপত্রও লাগে না।”
একটা সময়ে জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের হাতেও এমন সিম-কার্ড পৌঁছে যেত বলে অভিযোগ। এ জন্য একটি চক্রও সক্রিয় ছিল বলে দাবি পুলিশের। মাস দু’য়েক আগে এমন এক অসাধু ব্যবসায়ীর খোঁজে মেদিনীপুর শহরের নন্দীপুকুরপাড় ও তার আশপাশের এলাকায় তল্লাশিও চালিয়েছিল কাউন্টার ইনসার্জেন্সি ফোর্সে (সিআইএফ)। যদিও ওই ব্যবসায়ীর খোঁজ মেলেনি। জেলা পুলিশ সূত্রে খবর, আত্মসমর্পণকারী এক ‘মাওবাদী’র কাছ থেকেই জানা যায়, কী ভাবে কাগজপত্র ছাড়াই মোবাইলের ‘সিম’ জঙ্গলমহলে পৌঁছত।
সাধারণ গ্রাহকদের তাই দাবি, পুলিশকেই নজরদারি বাড়াতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতেনাতে ধরতে হবে। নজরদারি বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন পুলিশ সুপার। একটি সার্ভিস-প্রোভাইডার সংস্থার আধিকারিকও জানিয়েছেন, কোনও রিটেলারের বিরুদ্ধে নথিপত্রে গোলমালের অভিযোগ পেলে পদক্ষেপ করা হবে। এখন এই আশ্বাসই ভরসা। |
|
|
|
|
|