|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
কষ্ট সর্বশক্তিমান, কারণ তাহা সত্য |
সুতরাং, যা চলছে, তা-ই চলুক। কিছু ঘটলে একটু আলোড়ন। ফের নীরবতা।
মেনে নিয়েছি, এ লড়াই বাঁচার লড়াই, সুতরাং কষ্টই ভবিতব্য। তার পর? লিখছেন শোভন তরফদার |
কয়েক দশক আগের একটি ছবিতে জনৈক ক্ষিপ্ত, বিধ্বস্ত চরিত্র স্বগতোক্তির মতো বলেছিল, ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে! অনেকটা সে রকমই কি মনে হল তাঁদের, যাঁরা চল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের তপ্ত মাঠে শুরু করলেন হাঁটা! ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে, কিন্তু সেই দহনকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। অগ্নিপরীক্ষার অন্তে চাকরির ছিমছাম চুক্তি।
তার পর, এই সম্প্রতি, কী হল, তা অনেকেই জানেন। প্রখর রোদ মাথায় নিয়ে শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষা। তার ফলে প্রথমে একটি, কয়েক দিন পরে আরও একটি, মোট দু’টি মৃত্যু।
তাঁরা এও জানেন, এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে, হয়তো সতর্ক না হলে পুনর্বার ঘটবে! আইনি পরিভাষা কী বলবে ঠিক জানা নেই, কিন্তু এই দু’টি মৃত্যুকে ‘হত্যা’ বললে, অন্তত নৈতিক অর্থে, কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। মজা এই যে নীতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার দায়ই বা কার? প্রশাসনিক পরিভাষা নিয়ে সকলে ব্যস্ত (এবং এই মুহূর্তে, উপরোক্ত দু’টি মৃত্যু প্রসঙ্গে ঈষৎ বিব্রতও হয়তো বা)! নৈতিক সংকট নিয়ে উদাসীন থাকার সুবিধাটা হল আগে একাধিক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, নৈতিকতা নিয়ে নাগরিকের ক্ষোভ দ্রুত এলিয়ে পড়ে। সুতরাং, বিতর্ক জিইয়ে থাকার শঙ্কা কম।
বরং, এই তৃতীয় এবং উন্নয়নশীল বিশ্বে, চাকরি পাওয়ার জন্য যে ‘কষ্ট’ করতেই হবে, তা নিয়ে ঐকমত্য বিপুল। কথাটাকে আরও কিছুটা এগিয়ে নেওয়া যায়। শুধু চাকরি কেন, বাঁচতে গেলেই কষ্ট করতে হবে। প্রতি পদে কষ্টে করতে হবে। এ লড়াই বাঁচার লড়াই। অথচ মানুষকে সেই ‘কষ্ট’ দেওয়াটা কোথায় গিয়ে অ-নৈতিক হয়ে দাঁড়ায়, সেই তর্ক ওঠে না। অথচ, তর্কটা জরুরি।
এই কারণে জরুরি যে সে ক্ষেত্রে যাঁরা কষ্ট করছেন (কষ্ট করে পরীক্ষা দিচ্ছেন), এবং যাঁরা তা নিচ্ছেন (অর্থাৎ, কষ্টের পরীক্ষা নিচ্ছেন), দু’তরফেরই একটা মাত্রাজ্ঞান আসতে পারে। সেই জ্ঞান আদপেই আসে না। কারণ, এই খেলাটা চূড়ান্ত ভাবেই অসম। ‘কষ্ট’ যে করে, সে এটাকে এক ধরনের কর্তব্য বলেই ভেবে নেয়। ফলে, ‘কষ্ট’ যে দেয়, তার নৈতিক অবস্থান আপনা থেকেই অতি উচ্চ, প্রায় ঈশ্বরের মতোই হয়ে ওঠে যেন। সেই কাজ কতদূর নৈতিক, সেই প্রশ্ন আর উঠতেই পারে না। |
|
সমবেদনা। তপ্ত মহানগরের পথে কর্মরত ট্রাফিক পুলিশ-এর পাশে
নগরপাল রঞ্জিতকুমার পচনন্দা। জুন, ২০১২ |
ফলে, ভরদুপুরে তেতে-ওঠা ময়দানে হাঁটার পরীক্ষা চলে। যাঁরা পরীক্ষা নেবেন, তাঁরা তো আসলে বিধাতা। ভাতকাপড়ের হিল্লে করে দেবেন, বিধাতা ছাড়া আর কী? কথা বোলো না, কেউ শব্দ কোরো না, হাঁটতে শুরু করো।
সুতরাং, ভোর থেকে শুরু করে গড়ানো বেলা পর্যন্ত লাইন দিয়ে ‘ফর্ম’ তোলা বা ‘ফর্ম’ জমা। প্রাপ্য টাকা পাওয়ার জন্য দিনের পর দিন সংশ্লিষ্ট দফতরে হাঁটাহাঁটি। প্রাপ্য একটি শংসাপত্র পাওয়ার আশায় দিনের পর দিন তদ্বির।
এই ‘কষ্ট’ তো করণীয়। সে কাজ ঠিক না ভুল, কত দূর ঠিক বা কতটুকু ভুল, জিজ্ঞাসে কোন জন?
এমনকী, কোনও কোনও একলা মুহূর্তে, খটকা লাগে, এমন সব চিন্তা আসলে পাপ নয় তো? পরীক্ষার আগে কেন অকথ্য ভাবে মাথার মধ্যে সমস্ত নোট, সমীকরণ ইত্যাদি বিবিধ বস্তু বোঝাই করব? কেন চাকরি খুঁজতে গিয়ে জুতোর সুকতলা ক্ষইয়ে ফেলব? কেন হাসপাতালের আউটডোরে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়াব? এমন সব প্রশ্ন মনে আনাও পাপ। এগুলো সত্য, কারণ এগুলো বাস্তব। ফালতু অ-বাস্তব ভাবনাচিন্তা করে লাভ কী?
আমাদের প্রাপ্য ঠিক কতটা, তা আমরা ভাল ভাবে জানি না। আমরা বিশ্বাস করি, একমাত্র কষ্টই করণীয়। বাকিটুকু?
মেলাবেন, তিনি মেলাবেন।
|
আমরা এবং মুন্নাভাই |
তা হলে ওই যে দু’টি ছেলে রোদ্দুরে হাঁটতে গিয়ে প্রাণ দিলেন, তাঁদের আমরা মানে এখনও যারা হিমসাগর আম বা শীতাতপনিয়ন্ত্রণের ভরসায় টিকে আছি এই গরমে কী ভাবে দেখব? তাঁদের রৌদ্রদগ্ধ শরীর কি আমাদের আরামে কোনও ছ্যাঁকা দেবে না? নাকি, ইউরো কাপ, মন্দা আর আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সাড়ে বত্রিশ ভাজায় দ্রুত ভুলে যাব সেই ঘটনা? এই পর্যন্ত গিয়ে একটা খটকা লাগে। খটকাটা এই যে ক্ষোভ বস্তুটা কোথাও যে থাকে না, তা তো নয়। ক্ষোভ থাকে। গণ-মানসের ভিতরেই ক্ষোভ জমে। পরিভাষায় যাকে ‘সিস্টেম’ বলে, তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ। ‘প্রথা’ বা ‘রীতি’ যাকে মানতে বাধ্য করায়, দৈনন্দিনের ক্লেশ তারই বিরুদ্ধে প্রবল রোষ তৈরি করে। দিনের ব্যস্ত সময়ে বাসে রোজ প্রবল ভিড়ে ঝুলে যেতে হয়। বাসে বাসে রেষারেষি চলে। যে কোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আমরা মুখ বুজে থাকি। ভাবখানা এ রকম, কী আর করা যাবে, এটাই রীতি! কিন্তু, আচমকা কোনও বাস দুর্ঘটনা ঘটালে তা সে যে সময়েই হোক না কেন তৎক্ষণাৎ গাড়ি ভাঙচুর, নানা দিক থেকে উড়ে আসা মন্তব্য ইত্যাদি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ভিতরে কতটা রাগ, কতটা অসহায়তা জমে আছে।
জনতা কষ্ট করছে, মুখে রা কাড়ছে না, সবই প্রায় মেনে নিচ্ছে ভবিতব্য হিসাবে, এ সবই সত্যি! আবার, মজাটা হল, জনতার হয়ে সেই রাগ যদি কেউ প্রকাশ করেন, বিহিত করেন সেই সব অন্যায়ের, তখন তাঁর নায়ক-এর মর্যাদা!
যেমন, মুন্নাভাই।
রোজকার জীবনের কোথায় কোথায় কী কী কষ্ট করতে হয়, কী ভাবে কষ্ট করতে হয়, সে সব আমরা জানি, এবং মানি!
মুন্নাভাইও জানেন, কিন্তু মানেন না।
আমরা জানি, পরীক্ষা মানে মাথার মধ্যে অনেক কিছু নিয়ে গিয়ে খাতায় তাকে উগরে দেওয়া! মুন্নাভাই তাঁর নিজস্ব কায়দায় সেই প্রথাকে ফর্দাফাঁই করে ছাড়েন। আমরা জানি, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে রোগীর চিকিৎসার আগে নানা রকম ফর্ম ইত্যাদি পূরণ করতে হয়, প্রশাসনিক নানাবিধ হ্যাপা সামলাতে হয়, লম্বা লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হয়, যদি সুফল মেলে! মুন্নাভাই সেই সব রীতিবিধি একেবারে উল্টে দেন।
এমনকী, যে মৃত্যুপথযাত্রীটি অপেক্ষা করেন শেষ প্রহরের জন্য, হাসপাতালের বেড-এর ধারে ‘আইটেম গার্ল’ আনার পরে তাঁর সেই প্রতীক্ষাও বদলে যায় আমূল।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই, আমরা উল্লাসে ফেটে পড়ি। মনে রাখা ভাল, এই সবই আসলে এক ধরনের নৈতিক সংকট! না হলে ‘সিস্টেম’ তো দিব্যি কাজ করছিল তার চেনা গতে। পরীক্ষা চলছিল। হাসপাতাল চলছিল। অথচ, সেই সরষের মধ্যে যে ভূতের বাস, সে কথা সেই গড্ডলিকার স্রোতে আর কে-ই বা মনে করে?
আমরা করি না। মুন্নাভাই করেন। তিনি ‘প্রথা’কে আক্রমণ করেন তাঁর ‘নীতিবোধ’ দিয়ে।
‘যা হয়ে থাকে’, সেটা যদি বাস্তব হয়, তা হলে ‘যা হওয়া উচিত’, সেটা জানায় নীতি। সেই নীতি মাঝেমাঝে বিবেকের গলায় ডাক দিয়ে যায়। কিন্তু, কে শোনে তার কথা? মুন্নাভাই শোনেন। তিনি দাবি করেন, যিনি কষ্ট পাচ্ছেন, সবার আগে তাঁর যন্ত্রণার উপশম করা হোক। তার পর, রীতি-টিতি সে সব নিয়ে ভাবা যাবে। তিনি এও জানান, অবশ্যই একদম নিজের ভঙ্গিতে, যে পরিষেবা প্রাপ্য, তা পাওয়ার জন্য চূড়ান্ত কষ্ট করতে হবে কেন?
যে কাজ করা উচিত নয় বলে আমরা সকলেই জানি, তা কেন চলবে? কেন সেই প্রথা অবিলম্বে বন্ধ করা হবে না? প্রশ্নটাকে একটু অন্য ভাবে দেখলে, যে পরিস্থিতিতে দৌড় প্রাণঘাতী হতে পারে বলে আমরা সকলেই জানি, সেই পরিস্থিতিতে দৌড়ের পরীক্ষা কেন-ই বা নেওয়া হবে?
|
সামাজিক নই? |
অথচ, সেই দৌড় হয়। তাতে প্রাণও যায়। তার পর? ‘সিস্টেম’-এর প্রতি জনতার ক্ষোভ তৈরি হয়, মিলিয়েও যায়। সব মিলিয়ে এক বিচিত্র নৈতিক সংকট। নীতির ব্যাপারটা ছাড়তেও পারছি না (মনের টান, উপায় কী), কিন্তু বাস্তবে সেই নীতিকে আঁকড়ে এগোনোর সাহসও দেখাতে পারছি না! নীতি মানতে গেলে যদি লোকে বলে, মূর্খ বড়, সামাজিক নয়?
তা হলে কি ‘নীতি’-র প্রশ্নটা একটা বড় অর্থে অ-‘সামাজিক’ হয়ে পড়ল? তা হলে কি ‘সামাজিক’ থাকার একটা বড় উপায় হল যা ঘটছে, মুখ বুজে তাকেই মেনে নেওয়া?
প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবনাচিন্তা জরুরি। সেই সব হতে হতে অবশ্য এই দু’টি মৃত্যুর স্মৃতি ঝাপসা হয়ে আসতে পারে। তাতে আমাদের, সমাজের বৃহত্তর অংশের প্রায় কিছুই যায় আসে না। আমরা কষ্ট পেতেই থাকি। কষ্ট সর্বশক্তিমান, কারণ তাহা সত্য। বড়জোর বাসে বা গাড়িতে এফ এম-এ কবীর সুমনের গান, সঞ্জীব পুরোহিত হাঁটলেন চাকরি পাবেন এই ভরসায়। তখন চক্ষুতারা একটু আর্দ্র হয়ে আসে। বাইরে প্রখর রোদ। বৃষ্টির দেখা নেই। মাথায় চাবুক মারে রোদ্দুর।
ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে।
কিপ ওয়াকিং... |
|
|
|
|
|