|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
প্রাসাদের মোহে গুরুঙ্গ আপাতত কানাগলিতে |
সুবাস ঘিসিং পাহাড়কেই তাঁর পাখির চোখ করেছিলেন। ডুয়ার্স-তরাইকে জিটিএ-র
অন্তর্ভুক্ত
করতে গিয়েই গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা দ’য়ে পড়েছে। লিখছেন শিবাজীপ্রতিম বসু |
পাহাড়ি পথের চড়াই-উতরাই একনাগাড়ে পেরোতে পেরোতে, কখনও খাদের রোমহর্ষক কিনারে, কখনও বা সবুজ উপত্যকার বুক চিরে গাড়িটা চলছিল কোনও মতে। এক এক সময় মনে হচ্ছিল যন্ত্রটা বিকল হয়ে গেছে, চালকের ক্ষমতাও নিঃশেষ, গাড়ি আর চলবে না। সেই মুহূর্তে না-জানি কী ভাবে কোথা থেকে নতুন চালকের আবির্ভাব হয়েছে, পুরনো যন্ত্রে প্রাণসঞ্চার করে সে ফের খুঁজে পেয়েছে নতুন এবং জটিল পথের দিশা। গাড়িটা ফের চলতে শুরু করেছে।
এ ভাবেই দার্জিলিং পাহাড়ে গোর্খা জনগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্যলাভের গাড়ি, স্বাধীনতার আগে থেকেই এবং বিশেষত পরে নানা চালক বদলাতে বদলাতে, অবশেষে ১৯৮০-র দশকের শেষাশেষি, সুবাস ঘিসিঙের চালনায় গোর্খা পার্বত্য পরিষদের (ডি জি এইচ সি) শিখরে পৌঁছয়। সেখানে প্রায় দু’দশকের অবস্থান শেষে নতুন শিখরলাভ: সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় দার্জিলিংবাসীদের জন্য আরও বেশি ক্ষমতা ও মর্যাদা কায়েম করা যখন প্রায় স্থির, তখনই দেখা গেল চালক (ঘিসিং) দাঁড়িয়ে আছেন খাদের কিনারায়, বাকি যাত্রীরা তাঁকে ফেলেই গাড়িতে উঠে পড়েছেন। কারণ, নতুন চালক বিমল গুরুঙ্গ তাঁদের কথা দিয়েছেন যে, কোনও আপস না করেই তিনি সবাইকে পৌঁছে দেবেন শেষ গন্তব্য ‘গোর্খাল্যান্ড’-এর ঈপ্সিত দোরগোড়ায়। পরের বছর চারেক, লাগাতার আন্দোলনের ঘূর্ণিপথে সবাইকে শ্রান্ত, ক্লান্ত, এমনকী বিরক্ত করে তিনি তাঁর গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়লেন এমন এক সুসজ্জিত গলির মধ্যে, যার শেষ প্রান্তে রয়েছে এক মোহময় প্রাসাদ।
এটি অবশ্য দার্জিলিংবাসীর স্বপ্নের গোর্খাল্যান্ড নয়, তার নাম ‘গোর্খা টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ বা জি টি এ। পূর্বতন ডি জি এইচ সি-র থেকে, এমনকী ষষ্ঠ তফসিলের সম্ভাব্য ক্ষমতা থেকে জি টি এ বেশি শক্তিধর। ‘টেরিটরি’ বা ‘ভূখণ্ড’ কথাটির মধ্যেই রয়েছে ক্ষমতার এক অনিবার্য মোহ, কেননা, আধুনিক কালে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান উপাদান হল তার নির্দিষ্ট কোনও ভূখণ্ডগত পরিচয়। এই ভূখণ্ডকে আরও পুষ্ট ও প্রসারিত করতে গুরুঙ্গ ও তাঁর সহযোগীরা ঢুকে পড়তে চাইলেন পাহাড়ের নীচে, তরাই-ডুয়ার্সে প্রায় চারশো মৌজার অলিতে-গলিতে। আর এই সব করতে করতেই তিনি প্রবেশ করলেন এক বদ্ধ-পথে, যেখান থেকে অন্যতর বা অন্যত্র উত্তরণের পথ প্রায় রুদ্ধ, বাংলায় যাকে বলে ‘কানাগলি’, ঠিক তাই। ফলে, প্রথমে পার্বত্য পরিষদ, পরে প্রায়-ছুঁই-ছুঁই ষষ্ঠ তফসিল ও সব শেষে জিটিএ। তারও পরে রুদ্ধপথ, আর কোথাও এগোনো সম্ভব নয়। |
|
উদ্বিগ্ন? অনুগামীদের সঙ্গে বিমল গুরুঙ্গ। |
গোর্খা জনগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্যলাভ ও তার ভূখণ্ডগত প্রসারের বাসনা কিন্তু হালফিলের নয়, অনেক পুরনো। আজ থেকে ১০৫ বছর আগে, ১৯০৭ সালে মুখ্যত ইংরেজ-গরিষ্ঠ চা-বাগানের মালিকদের সংগঠন প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশন ও ইউরোপিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, ‘সিটিজেন্স অব দ্য দার্জিলিং হিল’-এর নামে দার্জিলিং ও ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে বাংলা থেকে পৃথক একটি রাজ্য গড়ার জন্য ১৯০৬ সালে গঠিত মর্লি-মিন্টো শাসনতান্ত্রিক সংস্কার কমিটির কাছে দরবার করেছিল। এর পিছনে ছিল চা-বাগান শ্রমিকদের বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫)-বিরোধী স্বদেশি তথা বিপ্লবী আন্দোলনের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার জন্য বাগান-মালিকদের প্রচেষ্টা। গোড়ায় এতে মদত ছিল ঔপনিবেশিক সরকারেরও। কিন্তু একই সঙ্গে তাদের ছিল দার্জিলিং-পার্শ্ববর্তী তিব্বত নিয়ে দুশ্চিন্তা, যে-তিব্বতের ওপর আধিপত্য খাটিয়ে তারা চিনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিল। কিন্তু তিব্বতিরাও ইংরেজদের এই প্রয়াসে সাধ্যমত বাধা দিয়েছিল। অন্য দিকে, জারের রাশিয়ারও তিব্বতের ওপর নজর ছিল। ফলে, গোড়ায় মদত দিলেও শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের বিখ্যাত বাস্তববাদিতাই জয়ী হয়। তিব্বতের নাকের ডগায় একটি তুলনায় দুর্বল প্রদেশ গড়ার চাইতে তাকে প্রশাসনিক দিক থেকে শক্তপোক্ত বাংলাতে রেখে দেওয়াই সাব্যস্ত করেছিল। এর পর ১৯৩৪ সালে হিলমেন্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিদল তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট, স্যামুয়েল হোর-এর কাছে ফের দার্জিলিংকে পৃথক রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার দাবি তোলেন। ১৯৪৩ সালে গোর্খা লিগের প্রতিষ্ঠা হলে তারা দার্জিলিং ও ডুয়ার্সকে অসমের সঙ্গে দাবি তোলে। স্বাধীনতার প্রাক্কালে, ১৯৪৭ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দার্জিলিং জেলা কমিটির পক্ষ থেকে রতনলাল ব্রাহ্মণ এবং জি এল সুব্বা দার্জিলিং-ডুয়ার্স নিয়ে পৃথক গোর্খাস্থানের দাবি জানান।
সুবাস ঘিসিং কিন্তু তরাই-ডুয়ার্সের চেয়েও দার্জিলিঙের তিনটি পার্বত্য মহকুমাকেই ‘পাখির চোখ’ করেছিলেন। এই অঞ্চল আদতে লেপচা-লিম্বু ও কিছু পরিমাণে ভুটিয়াদের আদি বাসভূমি হলেও চা-বাগান সূত্রে নানা শ্রেণির নেপালি মানুষ, বিশেষ করে গোর্খা সম্প্রদায়ের মানুষ উনিশ শতক থেকেই ধীরে ধীরে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও প্রবল হয়ে ওঠে। ফলে, জনগোষ্ঠীর ঘনত্বগত ‘কম্প্যাক্টনেস’-এর কারণে ঘিসিঙের আন্দোলন অনেক বেশি কার্যকর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু গুরুঙ্গের নেতৃত্বে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা ডুয়ার্স-তরাইয়ের আদিবাসী/মদেশিয়া অধ্যুষিত (চা-শ্রমিক হিসেবে আসা ছোটনাগপুর থেকে আনা নানা সম্প্রদায়ের, মুখ্যত সাঁওতাল-গরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীগুলি) অঞ্চল প্রস্তাবিত জি টি এ-র কব্জায় আনতে গিয়ে পড়লেন বিশ বাঁও জলে। কারণ, এই অঞ্চলের কিছু কিছু ‘পকেটে’ নেপালি ও ভুটান থেকে বিতাড়িত নেপালি বা ‘ভুপালি’রা থাকলেও, তাঁরা সময়ের বিচারে, আদিবাসীদের তুলনায় নিদারুণ ভাবে সংখ্যালঘু। ফলে, ‘কম্প্যাক্টনেস’-এর অভাবজনিত কারণে এই অঞ্চলকে গোর্খা এলাকার অন্তর্ভুক্ত করতে কেবল বিচারপতি শ্যামল সেনের কমিটির নয়, যে-কোনও যুক্তিশীল মানুষেরই বাধবে, গোর্খাদের প্রতি সহানুভূতি থাকলেও। তা ছাড়া ঐতিহাসিক ভাবে সাঁওতালরা অত্যন্ত স্বাধীনচেতা মানুষ, সংখ্যালঘু গোর্খাদের আধিপত্য তাঁরা কিছুতেই মেনে নেবেন না। জোর করে চাপাতে গেলে আগুন জ্বলবে।
ফলে, ডুয়ার্স-তরাইকে জি টি এ-র অন্তর্ভুক্ত করতে গিয়ে গুরুঙ্গ ও তাঁর মোর্চা দ’এ পড়েছেন। এখন, পৃথক গোর্খাল্যান্ড গড়ার চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়াল তরাই-ডুয়ার্সের অন্তর্ভুক্তির অতি জটিল প্রশ্ন যার আশু গোর্খা-সাপেক্ষ সমাধান অসম্ভব। অর্থাৎ, পাহাড়ে জি টি এ গঠন ও গোর্খাল্যান্ডের দাবির প্রতর্কটি এখন পাক খাবে শ্যামল সেন কমিটির নানা সুপারিশের খুঁটিনাটি বিচারে ও এই কমিটির মুণ্ডপাতে।
অবশ্য, পৃথক রাজ্য চাইলেও যে তা সহজে পাওয়া যাবে না, এ কথা ঘিসিং জানতেন, এখনকার নেতারাও নিশ্চয়ই তা বোঝেন। এর কারণ একমাত্র ‘বাঙালি সেন্টিমেন্ট’ নয়। যে তিব্বত-সংলগ্নতার কারণে একদা ইংরেজরা দার্জিলিংকে পৃথক করতে গিয়েও করেনি, তিব্বত চিনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে এবং নেপালে মাওবাদীরা ক্ষমতায় আসার পর থেকে নেপাল-চিনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ার ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের দিক থেকে সেই ‘দুশ্চিন্তা’ আরও বেড়েছে। একই সঙ্গে রয়েছে ভারত-নেপাল মৈত্রী চুক্তির গেরো যার জেরে নেপাল বা ভারতের নাগরিকরা একে অন্যের দেশে বিনা বাধায় যাতায়াত, স্থায়ী বসবাস ও ব্যবসাবাণিজ্য করতে পারেন। পৃথক রাজ্য হলে দলে দলে নেপালিরা এসে ‘গোর্খাল্যান্ড’-এ বসবাস করতে শুরু করতে পারেন, যে সম্ভাবনায় বিদেশ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সিঁদুরে মেঘ দেখে।
কেবল জি টি এ-র জট নয়। আরও যে দুটো জিনিস গুরুঙ্গের কপালে ভাঁজ ফেলেছে, তা হল, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বা ব্যবসায়ীদের নতুন করে আন্দোলনের ব্যাপারে তীব্র অনীহা। এ বারের পর্যটন মরসুমে তাঁরা একটু লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছেন। সে সবে ছাই ফেলতে কে-ই বা চায়! আর একটা খবর বাতাসে ভাসছে, হরকা বাহাদুরের মতো কেউ কেউ গুরুঙ্গের একগুঁয়েমিতে বিরক্ত হয়ে রাজ্যের বর্তমান শাসক পক্ষের সঙ্গে একটা রফায় আসতে চাইছেন। তারই একটু ঝলক দেখা গেল কার্সিয়াং অঞ্চলের কিছু প্রাক্তন জনমুক্তি মোর্চা ও ঘিসিং-ঘনিষ্ঠ নেতার তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদানে। তাই জুলাইয়ে ফের গুরুঙ্গের বজ্রনির্ঘোষ শোনা গেলেও গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের আপাতত ডেড এন্ড।
|
শ্রীচৈতন্য কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক |
|
|
|
|
|