কংগ্রেস তো বটেই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গুগলি’-তে বিভ্রান্ত সিপিএম তথা বাম নেতৃত্বও।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী আজ যে ভাবে মুলায়ম সিংহ যাদবকে সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্রপতি পদে এ পি জে আব্দুল কালামের পাশাপাশি মনমোহন সিংহ ও সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নাম প্রস্তাব করেছেন, তাতে ফাঁপরে পড়েছে সিপিএম নেতৃত্ব। এ কে গোপালন ভবনের নেতাদের মতে, প্রধানমন্ত্রীর নাম নিয়ে এক দিকে মমতা-মুলায়ম ইউপিএ-সরকারের অস্তিত্বের সঙ্কট যেমন তৈরি করেছেন, তেমনই দল থেকে বহিষ্কৃত সোমনাথবাবুর নাম টেনে এনে সিপিএমকে অস্বস্তিতে ফেলেছেন। সিপিএম নেতাদের মতে, মমতা খুব ভাল করেই জানেন, সিপিএমের পক্ষে কোনও ভাবেই এক জন বহিষ্কৃত নেতাকে সমর্থন করা সম্ভব নয়। কিন্তু সোমনাথবাবুকে নিয়ে দলের একাংশের মধ্যে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের
নেতাদের যে ‘নরম মনোভাব’ রয়েছে, তা-ও তাঁর অজানা নয়।
সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় এখন লন্ডনে। মমতা-শিবির থেকে তাঁর নাম উঠে আসার পরে একটি সংবাদ চ্যানেলে তিনি যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, তা-ও সিপিএম নেতাদের অস্বস্তিতে ফেলেছে। সোমনাথবাবু বলেছেন, “দেশের প্রথম নাগরিক হওয়া বিরাট সম্মানের ব্যাপার। আমি কখনও এটা কল্পনাও করিনি।” সোমনাথবাবু জানান, তাঁর সঙ্গে কেউ এখনও যোগাযোগ করেননি।
প্রথম ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের পরে সোমনাথকে স্পিকার পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার নির্দেশ দেয় দল। তা অমান্য করায় তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। সিপিএমের নিয়ম অনুযায়ী, বহিষ্কৃত নেতার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখা যায় না। কিন্তু বুদ্ধদেব-বিমান-সহ পশ্চিমবঙ্গের কিছু সিপিএম নেতা সোমনাথের প্রতি বরাবরই নরম মনোভাব নিয়ে এসেছেন। অতীতে জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে না দেওয়া নিয়ে দলের মধ্যে বিতর্ক হয়েছিল। এ বার আর এক বাঙালি সোমনাথবাবুকে সিপিএম রাষ্ট্রপতি হতে দিল না, এমন বার্তা দল দিতে চাইবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
কংগ্রেসের মতোই তাই আজ সিপিএম নেতারাও মুখে তালা-চাবি দিয়েছেন। তবে ঘরোয়া আলোচনায় তাঁরা বলছেন, মমতার নজর আসলে পরের লোকসভা ভোট। মুলায়ম-মমতা দু’জনেই চাইছেন, লোকসভা ভোট এগিয়ে আসুক। তাঁদের ধারণা, শীঘ্র নির্বাচন হলে উত্তরপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে বেশি ভাল ফল করবে সমাজবাদী পার্টি ও তৃণমূল। আর সেই উদ্দেশ্যেই এক দিকে সনিয়ার প্রস্তাবিত দু’টি নাম খারিজ করে দিয়ে, সরাসরি মনমোহনের নাম নিয়ে ইউপিএ সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছেন তাঁরা। এই পরিস্থিতিতে কি বামেরা ইউপিএ-র প্রার্থীকে সমর্থন করবে? সিপিএম সূত্রের বক্তব্য, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সংখ্যার নিরিখে বামেদের পক্ষে মমতা-মুলায়মের বিকল্প হওয়া সম্ভব নয়। উদারনীতির ধ্বজাধারী কংগ্রেস বা ইউপিএ-র প্রার্থীকে সমর্থন করা নিয়েও বাম শিবিরে প্রশ্ন রয়েছে।
এ কে গোপালন ভবনের এক নেতার দাবি, “সোমনাথের প্রশ্নে দলে এখন আর মতপার্থক্য নেই। কেউই সোমনাথকে সমর্থন করার পক্ষে সওয়াল করবেন না। বরং ওই সমস্যাটা প্রণববাবুর নাম নিয়ে হতে পারে। তাঁকে সমর্থন করার পক্ষে-বিপক্ষে দু’রকম মতই রয়েছে।” এই সিপিএম নেতার ব্যাখ্যা, যে ইউপিএ-র সব নীতির বিরোধিতা করছে বামেরা, সেই সরকারের অর্থমন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতি পদে কী ভাবে সমর্থন করা সম্ভব? পাল্টা যুক্তি, সোমনাথ ও প্রণব, রাষ্ট্রপতি পদে দুই বাঙালির নামেই বিরোধিতা করে বামেরা পশ্চিমবঙ্গে কোন মুখ নিয়ে মানুষের সামনে দাঁড়াবে? ব্যক্তিগত সম্পর্কের খাতিরেও বহু সিপিএম নেতাই প্রণববাবুর বিরোধিতা করতে রাজি নন।
দলীয় সূত্রের বক্তব্য, রাষ্ট্রপতি পদের দৌড়ে আজ যে পাঁচটি নাম উঠেছে, তার মধ্যে একমাত্র হামিদ আনসারি ইউপিএ-র প্রার্থী হলে বামেদের পক্ষে সমর্থন করা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু মনমোহন বা কালামকে সমর্থনের প্রশ্ন নেই। ২০০২-এ কালামের বিরুদ্ধে বামেরাই লক্ষ্মী সেহগলকে প্রার্থী করেছিল।
পরিস্থিতি বুঝে এখন তাই ‘স্পিকটি নট’ নীতিই শ্রেষ্ঠ কৌশল বলে মনে করছে সিপিএম নেতৃত্ব। দলের বক্তব্য, ইউপিএ নিজের প্রার্থী ঘোষণা করার পরেই বামেরা তাদের অবস্থান জানাবে। মমতা-মুলায়মের গুগলির পরে সনিয়া-মনমোহন তথা প্রণববাবু নিজে কী কৌশল নিচ্ছেন, তা-ও দেখতে চাইছেন তাঁরা। গত বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিভা পাটিলের নাম কারওর মাথাতেই ছিল না। এ বারও এই পাঁচটি নামের বাইরে নতুন কোনও নাম উঠে আসে কি না, তার জন্যও অপেক্ষা করতে চাইছেন কারাট-ইয়েচুরি-ডি রাজারা। |