দিনভর উৎকণ্ঠা। তার মাঝে ‘সম্ভাবনার’ একটু ঝিলিক খেলেই যেন আজ হতাশায় ডুব দিল নর্থ ব্লকের অর্থ মন্ত্রক। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের দেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কি তা হলে শেষ! যদিও গভীর রাত পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রতিমন্ত্রী ভি নারায়ণস্বামী ও সনিয়া গাঁধীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা আহমেদ পটেলের দীর্ঘ বৈঠক হয়। যে বৈঠকের শেষে প্রণব-শিবিরের দাবি, আগামিকাল প্রার্থী হিসেবে কংগ্রেস প্রণবের নাম ঘোষণা করে দিতে পারে।
সেই কবে থেকে প্রহর গুনছে অর্থ মন্ত্রক। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই নিয়ে ডিএমকে প্রধান করুণানিধির সঙ্গে বৈঠকের জন্য গত ২৯ এপ্রিল এ কে অ্যান্টনিকে পাঠিয়েছিলেন সনিয়া। তার পর প্রণববাবু এবং উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারির নাম সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে উঠে আসে। |
অর্থমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠদের তবু আশঙ্কা ছিল, সনিয়া কি শেষ পর্যন্ত প্রণববাবুর নাম প্রস্তাব করবেন? এপ্রিলের মাঝামাঝি প্রণববাবুর সঙ্গে বৈঠকেই কংগ্রেস সভানেত্রী বলেছিলেন, আপনাকে কী করে ছেড়ে দিই বলুন তো? আপনার বিকল্পই তো পাচ্ছি না। তার পর থেকে গত কাল পর্যন্ত সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে কারও নামই কিন্তু জানায়নি কংগ্রেস। শুধু জানায় যে, প্রার্থীর নাম এখনও চূড়ান্ত করেননি সনিয়া। অথচ এই অবস্থায় প্রণববাবুরও সংশয় ছিল না যে, সনিয়া শেষ পর্যন্ত কার কার নাম প্রস্তাব করবেন তা আজই প্রকাশ্যে এসে যাবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকে সনিয়াকে নাম জানাতেই হবে।
স্বভাবতই অর্থ মন্ত্রকের প্রতিটি ঘরের আজ নজর ছিল টিভিতে। কখন মমতা ১০ জনপথে যাবেন? বেরিয়ে কী বলবেন?
তবে প্রণববাবু আজ তাঁর রুটিন কর্মসূচিই রেখেছিলেন। সকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক ছিল। তার পর প্রাক্তন রেলমন্ত্রী সি কে জাফর শরিফ এবং কংগ্রেস নেতা মণিশঙ্কর আইয়ার তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। মধ্যাহ্নভোজন সেরে অর্থ মন্ত্রকে অ্যান্টি চেম্বারে বিশ্রাম নিতে যান প্রণববাবু। বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ মমতা যখন ১০ জনপথে ঢুকছেন, তখনও বিশ্রাম নিচ্ছেন প্রণববাবু। ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে চেয়ারে বসেন বিকেল সওয়া পাঁচটা নাগাদ। তার পাঁচ মিনিট পরেই টিভিতে দেখা যায় ১০ জনপথ থেকে বেরিয়ে তৃণমূল নেত্রী বলছেন, সনিয়া জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হিসেবে তাঁর পছন্দ দু’জন প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং হামিদ আনসারি।
মুহূর্তে উৎসবের ঝিলিক নর্থ ব্লকে। তা হলে রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন প্রণববাবু! অর্থমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠদের ধারণা ছিল, অন্তত মুলায়ম সিংহ কংগ্রেসের প্রথম পছন্দের ব্যক্তির নাম খারিজ করবেন না। মুলায়ম-মমতা কথার পরেই ছবিটা স্পষ্ট হবে।
কিন্তু প্রণববাবুও কি তা-ই মনে করছিলেন? মমতার বিবৃতি বৈদ্যুতিন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই অর্থমন্ত্রীর মোবাইলে পরপর আসতে থাকে শুভেচ্ছা বার্তা। কিন্তু বরাবর ‘কপি বুক’ রাজনীতি করে আসা কংগ্রেস নেতাটি তখনও উচ্ছ্বাস দেখাতে চাননি। বরং বলেছেন, “কংগ্রেসের তরফে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা তো এখনও হয়নি। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা যত ক্ষণ না হবে, তত ক্ষণ কোনও প্রতিক্রিয়া দেব না।” এর পর রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থাগুলির কর্তাদের সঙ্গে পূর্ব নির্ধারিত বৈঠকে বসেন তিনি। মুলয়াম-মমতা বৈঠকে কী ঘোষণা হল, তার জন্য অপেক্ষাও করেননি। নর্থ ব্লকের দেড় কিলোমিটার দূরে ১৬ নম্বর অশোক রোডে মমতা-মুলায়ম যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনের সময়েও প্রণববাবু ছিলেন সেই বৈঠকেই। |
কিন্তু তাঁর মন্ত্রকে বাকিদের নজর ছিল টিভির পর্দায়। কার্যত বিশ্বকাপ ফাইনালের মতোই উত্তেজনা। কিন্তু বলটা যে এমন গুগলি হবে কে জানত! মমতা-মুলায়ম কী বলতে চাইলেন, প্রথম মিনিট পাঁচেক কার্যত ঠাওর করতে পারছিলেন না প্রণববাবুর ব্যক্তিগত সহায়ক, অতিরিক্ত ব্যক্তিগত সহায়ক বা ঘনিষ্ঠ আমলারা। পরিস্থিতিটা বুঝে ওঠার পরেই সন্ধ্যার অন্ধকার যেন দ্রুত নামল অর্থ মন্ত্রকে। মুহূর্তে নিথর হল অলিন্দ। এক ঘণ্টার চাপা আনন্দ মরীচিকার মতোই মিলিয়ে গেল।
আর প্রণববাবু? বিমা সংস্থার কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর ঘরে এসে বসেন তিনি। উপদেষ্টা ও ব্যক্তিগত সহায়কদের কাছ থেকে মমতা-মুলায়ম সাংবাদিক বৈঠকের প্রতিপাদ্য জেনে নেন। তার পরেই কপাল কুঁচকে গভীর চিন্তায় ডুব। তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসা অর্থ মন্ত্রকের এক আমলা জানান, “উনি ধরেই নিয়েছেন এ যাত্রাতেও আর কোনও সম্ভাবনা রইল না।” এর কিছু ক্ষণের মধ্যেই প্রণববাবুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন পঞ্জাবের অর্থমন্ত্রী। ক’দিন আগে অমিত মিত্রের সঙ্গে প্রণববাবুর বৈঠকের সময়েই অর্থ মন্ত্রক সূত্রে বলা হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের মতোই আর্থিক প্যাকেজ পাবে পঞ্জাব ও কেরল। সেই সূত্রেই ওই বৈঠক। এর পর মন্ত্রী জয়রাম রমেশ আসেন প্রণববাবুর সঙ্গে দেখা করতে। আসেন কংগ্রেসেরই আর এক শীর্ষস্থানীয় নেতা। সূত্রের খবর, গোটা ঘটনা নিয়ে প্রণববাবুকে তিনি প্রশ্ন করলে ক্ষণিক নীরব থাকেন অর্থমন্ত্রী। তার পর বলেন সঙ্কটের সময় আমার মাথা ঠান্ডা থাকে। এমন ঘটনা অনেক দেখেছি। এটা তেমন কোনও সঙ্কটই নয়। আর গোটা দিন ধরে ঘনিয়ে ওঠা সঙ্কটের মুখেও বরাবরের মতো প্রণববাবুর উপরেই ভরসা রেখেছে দল। রাতেই তাঁর সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রতিমন্ত্রী ভি নারায়ণস্বামী এবং কংগ্রেস নেতা আহমেদ পটেল। |