তিন বছর আগে আয়লায় ধুয়ে গিয়েছিল সর্বস্ব। জামাকাপড়, রান্নার সরঞ্জাম, মাটির ঘরটাও। কিন্তু মনের জোর হারায়নি সুন্দরবনের যোগেশগঞ্জের বিপুল মিস্ত্রি। ১০০ দিনের কাজে বাবার সঙ্গে মাটি কেটে পড়াশোনা চালিয়েছে। কাজ সেরে বাড়ি ফিরে কুপির আলোয় পড়ে মাধ্যমিকে ৫৫৫ নম্বর পেয়েছে হিঙ্গলগঞ্জের হেমনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের ওই ছাত্রটি।
দিনমজুরি করে সংসার চালান বিপুলের বাবা বাসুদেব মিস্ত্রি। মা ললিতাদেবী পরিচারিকার কাজ করেন। দু’জনের কেউই পড়াশোনা শেখেননি। তবে, ছেলেমেয়েকে পড়াচ্ছেন। ছেলের সাফল্যে দু’জনেরই মুখে হাসি ফুটেছে। ললিতাদেবীর কথায়, “পড়াশোনা না করলে কী পরিণতি হয়, আমরা বুঝতে পারছি।” বাসুদেববাবু বলেন, “ছেলেটা এতদূর এসেছে শুধু নিজের চেষ্টায়। কিন্তু এর পর ওকে কী ভাবে পড়াব ভেবে পাচ্ছি না।” বাসুদেববাবু দুশ্চিন্তা করলেও বিপুলের চোখে এখন ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন। ছাত্রের সাফল্যে গর্বিত স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মলয় মণ্ডল বলেন, “ছেলেটার মনের জোর আছে। ও যাতে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে তার চেষ্টা করব।”
মাটির ভাঙাচোরা বাড়িতে এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি। তাতে পড়াশোনায় বাধা পড়েনি ক্যানিংয়ের সন্দেশখালি গ্রামের বাপন নস্করের। রাতের পর রাত জেগে লণ্ঠনের আলোয় পড়াশোনা চালিয়ে দিনমজুর পরিবারের ছেলেটি ৬০৪ নম্বর পেয়েছে। |
ইটখোলা রাজনারায়ণ হাইস্কুলের পরীক্ষায় বরাবর প্রথম হওয়া বাপন মাধ্যমিকেও স্কুলে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে। সে বলছে, “চিকিৎসক হব। গ্রামের অসহায় মানুষদের নিখরচায় চিকিৎসা করব।” কিন্তু দুশ্চিন্তায় বাবা গোবিন্দ নস্কর। তাঁর উদ্বেগ, “উঁচু ক্লাসে ছেলেকে পড়ানোর তো অনেক খরচ! কী ভাবে চালাব, কিছুই বুঝতে পারছি না।”
মেয়ে আরও পড়তে চাওয়ায় বাপনের বাবার মতো একই রকম অসহায় বোধ করছেন বাঁকুড়ার রাজগ্রামের শিবদাস সু। চায়ের দোকানে কাজ করে সামান্য তাঁর রোজগার। টালির ছাউনির একটি মাত্র মাটির ঘর। এখনও বিদ্যুৎ আসেনি। এই বাড়ির মেয়ে প্রিয়া সু’র মেধা আর পরিশ্রমের কাছে হার মেনেছে দারিদ্র। রাজগ্রাম বিবেকানন্দ হিন্দু বিদ্যালয়ের এই ছাত্রী পেয়েছে ৫৩২ নম্বর। সে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে শিক্ষিকা হতে চায়। তার বাবা শিবদাস সু বলেন, “জমিজমা নেই। চায়ের দোকানে কাজ করে সামান্য টাকা পাই। মেয়েকে আর পড়াবার সামর্থ্য নেই। অথচ মেয়ে আরও পড়তে চায়।”
পরীক্ষায় ভাল নম্বর পাওয়ার জন্য সহায়ক বই তো দূরের কথা, পাঠ্য বই কেনারই ক্ষমতা ছিল না পুরুলিয়া জেলার মানবাজার রাধামাধব বিদ্যায়তনের ছাত্র বুবাই দত্তের। স্কুলের শিক্ষকরাই ক্লাসের ফাঁকে তাকে পড়া
বুঝিয়ে দিয়েছেন। এই প্রতিকূলতার মধ্যেই মাধ্যমিকে ৬০৩ নম্বর পেয়েছে সে। এটাই
স্কুলের সবোর্চ্চ নম্বর। ইন্দকুড়ি গ্রামে তাদের একটা মাত্র ঘর। সেই ঘরেই রান্না, শোওয়া, লেখাপড়া চলে। বাবা দিলীপ দত্ত গ্রামে গ্রামে সর্ষের তেল ফেরি করেন। বুবাই বলে, “বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চাই।” সংশয় বাবার গলায়। বলেন, “বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার খরচ তো
কম নয়! ওর সাধ পূরণ করা যাবে কি না, জানি না।”
৫৪৯ নম্বর পেয়েছে কোন্নগরের নবগ্রাম শিশুভারতী উচ্চ বিদ্যালয়ের
ছাত্র অজয় নাগ। কানাইপুর কলোনির বাসিন্দা অজয় উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চায়। স্বপ্ন দেখে ইঞ্জিনিয়ারিং
পড়ার। বাবা অশোক নাগ পঞ্চায়েতে ১০০ দিনের প্রকল্পের কর্মী। মা কৃষ্ণাদেবী পরিচারিকার কাজ করেন। তবুও জেদ অজয়ের গলায়, “যে ভাবেই হোক পড়াশোনা চালিয়ে যেতে
চাই। পরিবারের সবাইকে একটু সুখ দেওয়ার জন্য আমাকে অনেক লড়াই করতে হবে।” |
(প্রতিবেদন: নির্মল বসু, সামসুল হুদা, রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়,
সমীর দত্ত ও প্রকাশ পাল। ছবি: অভিজিৎ সিংহ) |