এক বছর আগের বিধানসভা ভোটের ‘ধারা’ই কি বজায় থাকবে?
নাকি তার প্রভাব পড়বে ‘ক্ষমতাসীন’ তৃণমূলের উপর?
‘ঘুরে দাঁড়ানো’র লড়াইয়ে সিপিএম তথা বামেরা ধরে রাখতে পারবে হলদিয়া-দুর্গাপুর?
একক লড়াইয়ে কংগ্রেস কি তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারবে?
শাসকজোটে ভোট-বিভাজনের সুবিধা পাবে বামেরা?
এমন বহুবিধ প্রশ্নের জবাব দিতে আজ, রবিবার বুথে যাবেন রাজ্যের ছ’টি পুরসভার ভোটাররা। যেখানে ভোটের আগে থেকেই সিপিএম এবং কংগ্রেস পর্যায়ক্রমে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসের’ অভিযোগ তুলে আসছে।
যে ছ’টি পুরসভায় ভোট হচ্ছে, তার মধ্যে গত বিধানসভা ভোটের ফলাফলের নিরিখে মাত্রই একটিতে এগিয়েছিল সিপিএম ধূপগুড়ি। নলহাটিতে এগিয়েছিল কংগ্রেস। বাকি চারটিতেই (নদিয়ার কুপার্স ক্যাম্প-সহ) প্রাপ্ত ভোটের শতাংশে এগিয়েছিল তৃণমূল। বিধানসভার সেই ভোটের ধারা অক্ষুণ্ণ থাকলে হলদিয়া এবং দুর্গাপুরের মতো গুরুত্বপূর্ণ দু’টি পুরসভাও প্রধান শাসক দলেরই দখল করার কথা। দক্ষিণবঙ্গের ওই দু’টি শহর ‘শিল্পাঞ্চল’ বলেই পরিচিত। বিরোধী দল যখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ‘শিল্প-বিরোধী’ বলে আক্রমণ শানাচ্ছে, তখন হলদিয়া-দুর্গাপুর দখল করাটা অবশ্যই মমতার কাছে ‘চ্যালেঞ্জ’। ঘটনাচক্রে, এই দুই শহরই একেবারে ‘গ্রামীণ’ পুরসভা নয়। ফলে নাগরিক বাসিন্দাদের উপর মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্যের প্রধান প্রশাসক মমতার ‘প্রভাব’ কতটা, সে জবাবও মিলবে এই ভোটে। গত এক বছরে পার্ক স্ট্রিট বা কার্টুন-কাণ্ডের মতো বিভিন্ন ঘটনায় তরুণ নাগরিক ভোটারদের একাংশ ‘মমতা-বিমুখ’ হয়ে পড়েছেন বলেই সিপিএমের দাবি। |
যার পাল্টা তৃণমূল শিবির বলছে, ওই সমস্ত ঘটনায় যদি কোনও ‘ক্ষতি’ হয়েও থাকে, কলকাতার আইপিএল-জয় এবং তৎপরবর্তী শাহরুখ খানের ‘ইডেন-সংবর্ধনা’ তা ভুলিয়ে দিতে পেরেছে।
প্রসঙ্গত, হলদিয়া এবং দুর্গাপুর দু’টি পুর-এলাকাতেই বিধানসভা ভোটে সিপিএমের চেয়ে গড়ে ৫ থেকে ১০ শতাংশ করে এগিয়েছিল তৃণমূল।
মাত্র ছ’টি পুরসভা হলেও বিধানসভা ভোটের পর এই প্রথম একটি পুরোদস্তুর ভোট হচ্ছে রাজ্যে (ভবানীপুর বিধানসভা এবং দক্ষিণ কলকাতা লোকসভার উপনির্বাচন বাদ দিলে। সে দু’টিই অনায়াসে জিতেছিলেন মমতা। যা প্রত্যাশিতই ছিল)। ফলে এই ভোট থেকে রাজ্য-রাজনীতির গতিপ্রকৃতির খানিকটা আঁচ পাওয়ার চেষ্টা করবেন রাজনীতির কারবারিরা। পুরভোটে মমতার মতো ‘হেভিওয়েট’ নেতাদের প্রচারে নামায়নি তৃণমূল। যেমন সিপিএম নামায়নি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। তবে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় এবং রাজ্যের প্রথম সারির প্রায় সমস্ত মন্ত্রীকে গুছিয়ে প্রচারে নামিয়েছিলেন মমতা। সিপিএম যেমন নামিয়েছিল বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু-সহ রাজ্যস্তরের নেতাদের। |
কংগ্রেস কুপার্স ক্যাম্প ও নলহাটি (সরকারি ভাবে নলহাটিতে গত পুরভোটে কংগ্রেস জিতলেও পরে তাঁরা তৃণমূলে যোগ দেন) ধরে রাখার ব্যাপারে কংগ্রেস ‘আশাবাদী’। বস্তুত, কুপার্স ক্যাম্প যেমন নদিয়া জেলা কংগ্রেস সভাপতি শঙ্কর সিংহের কাছে ‘ইজ্জতের লড়াই’, তেমনই নলহাটিও প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পুত্র, স্থানীয় বিধায়ক অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের কাছে ‘মর্যাদার লড়াই’।
ফলাফল প্রকাশিত হবে ভোটের ৪৮ ঘণ্টা পর, আগামী মঙ্গলবার।
কংগ্রেস ভোটের ফলাফল নিয়ে মতামত দিলেও এ দিন যুযুধান প্রধান দু’পক্ষের কোনও নেতাই বিশদে কিছু বলতে চাননি। সিপিএম ‘ধারাবাহিক সন্ত্রাসে’র অভিযোগ এদিনও তুলেছে। আর তৃণমূলের নেতাদের একাংশ বলেছেন, তাঁরা সামগ্রিক ভাবেই ভাল ফলাফলের আশা করছেন। তাঁদের বক্তব্য, সরকারি ভাবে একমাত্র পাঁশকুড়া ছাড়া (ওই পুরসভায় কংগ্রেস-তৃণমূল জোট গত পাঁচ বছর বোর্ড চালিয়েছে। কিন্তু এ বার ভোটের আগে জোট ভেঙে গিয়েছে। আর নলহাটিও আদতে জিতেছিল কংগ্রেস) কোনও পুরসভাতেই তাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন না। ফলে তাঁদের লড়াই দখল করার। পক্ষান্তরে, সিপিএম এবং কংগ্রেসের লড়াই ক্ষমতা ধরে রাখার। দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “খুব খারাপ হলেও অন্তত চারটে পুরসভা জিতছিই!” না-জেতার সম্ভাব্য তালিকায় তাঁরা রাখছেন নলহাটি বা কুপার্স এবং উত্তরবঙ্গের ধূপগুড়িকে। |
এই পুরভোটে ভাগ্য জড়িয়ে গিয়েছে অন্তত পাঁচ নেতানেত্রীর। তাঁদের মধ্যে এক নম্বরে অবশ্যই থাকবেন কংগ্রেসের শঙ্কর সিংহ। তার পর যথাক্রমে প্রণব-পুত্র অভিজিৎ, তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী, তমলুকের প্রাক্তন সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠের স্ত্রী তমালিকা পণ্ডাশেঠ এবং রাজ্যের উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। কুপার্সে হেরে গেলে শঙ্করের শেষ ‘দুর্গের’ও পতন ঘটবে। যেমন নলহাটি হারলে অভিজিতকে খোয়াতে হবে নিজের ‘খাসতালুক’। নন্দীগ্রাম-পর্বের পর থেকে শুভেন্দুর যে ধারাবাহিক ভোট-সাফল্য, তা থমকে যাবে হলদিয়া ও পাঁশকুড়া না-জিতলে। লক্ষ্মণ-সূর্য অস্তাচলে যাওয়ার পরে তমালিকাদেবী মহিষাদলে হেরেছেন। লক্ষ্মণবাবু আপাতত কারান্তরালে। হলদিয়ার পুরভোটে হারলে তাঁর স্ত্রী-ও কার্যত অন্তরালেই চলে যাবেন।
কিন্তু পুরভোটের প্রচারে না-নেমেও এঁদের সকলের চেয়েই সম্ভবত বড় পরীক্ষায় বসছেন মমতা স্বয়ং। এমনিতে পুরভোটে সাধারণত স্থানীয় সমস্যা বেশি গুরুত্ব পায়। কিন্তু ২০০৯-এর লোকসভা থেকে এ রাজ্যে যে তীব্র রাজনৈতিক মেরুকরণ হয়েছে, সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও এই ভোটও তার ব্যতিক্রম নয়। ফলে এর ‘রাজনৈতিক তাৎপর্য’ অন্য মাত্রা পেয়েছে। বিশেষত, যখন এর এক বছরের মাথায় রাজ্য জুড়ে পঞ্চায়েত ভোট। তার এক বছর পর লোকসভা নির্বাচন নির্ধারিত।
ফলে একইসঙ্গে এই ভোট ‘রাজনীতিক’ এবং ‘প্রশাসক’ উভয় মমতারই পরীক্ষা।
রাজনীতিক মমতার ‘ম্যাজিক’ কি এখনও অটুট?
প্রশাসক মমতা কেমন ‘ছাপ’ ফেললেন?
ভোট-মেশিনে বলবে ছয় পুরসভা। |