প্রবন্ধ...
গণতন্ত্রেশ্বরী
জুন মাস। যা কিছু উৎসব কিংবা অনুষ্ঠান, সবেরই জন্য ধার্য এই জুন মাসটি। ঐতিহ্য বলে কথা। একেই তো ব্রিটিশরা জাতি হিসেবে অত্যন্ত ঐতিহ্যমনস্ক, তার উপর এ তো খোদ বাকিংহ্যাম প্যালেস-এর ধারা। সুতরাং ব্রিটিশ রাজা বা রানির জন্মদিন, বিয়ের দিন, অভিষেকের দিন, শপথগ্রহণের দিন বছরের যে কোনও সময়েই হোক না কেন, উৎসবটা জুনের প্রথম সপ্তাহে হওয়াই দস্তুর। শীতকাতুরে দেশের গরমের ওম জুনে, হালকা বৃষ্টি মেঘের খেলা জুনে, দেশসুদ্ধ ছেলেমেয়ের ত্রৈমাসিক ছুটি আরম্ভ জুনে, উৎসবের সময় তো এটাই। আহা, ওদের কষ্ট হবে নয়তো! রাজপরিবার হলে কী হবে, বিবেক বলেও তো একটা বস্তু আছে!
সুতরাং তারিখটা যদিও ফেব্রুয়ারির ৬ তারিখ, অনুষ্ঠানটা হচ্ছে জুনের প্রথম সপ্তাহে। মহারানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজত্বের হীরকজয়ন্তী উদ্যাপন দেশবিদেশের অভ্যাগত এসে রানিকে অভিনন্দন জানাবেন, গোটা দেশের মানুষ মাতবে জয়-জয়রবে। মনে করা হবে ষাট বছর আগে, ১৯৫২ সালের সেই দিনটির কথা, লন্ডনের তীব্র শীত থেকে পালিয়ে কেনিয়ার জঙ্গলে স্বামী-সমভিব্যাহারে ছুটি কাটাতে কাটাতে হঠাৎ যে দিন পিতৃবিয়োগ সংবাদ এসে পৌঁছেছিল ছাব্বিশ বছরের রাজকন্যাটির কাছে।
বলা হবে কেমন ভাবে জঙ্গলে ‘ট্রি-হাউসে’ বসেই রাজকন্যা এলিজাবেথ এক মুহূর্তে রানি এলিজাবেথ হয়ে গেলেন। ষষ্ঠ জর্জ ছিলেন অপুত্রক, জ্যেষ্ঠা কন্যা এলিজাবেথ আলেকজান্দ্রা মেরি (১৯২৬), কনিষ্ঠাটি মার্গারেট (১৯৩০)। সুতরাং, যে কোনও মুহূর্তেই যে সসাগরা দুনিয়া, থুড়ি, সাম্রাজ্য, থুড়ি, কমনওয়েলথ-এর ভার এসে পড়তেই পারে তাঁর ছোটখাটো চেহারাটির উপর, তা তো জানাই ছিল। তবু, ভাবতে ইচ্ছে হয়, ঠিক কেমন লেগেছিল তাঁর, কী করেছিলেন তিনি এই সংবাদ পেয়ে? জানা অসম্ভব। এলিজাবেথ শিশুকাল থেকেই রীতিমত ‘রানি’-ভাবাক্রান্ত, ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভব লুকিয়ে রাখতে সিদ্ধহস্ত, এবং সেই দিনটির আর এক সাক্ষী তাঁর স্বামী প্রিন্স ফিলিপ, ডিউক অব এডিনবরাও তথৈবচ, বেশি কথা বলায় বিশ্বাস রাখেন না কোনও কালে।
তড়িঘড়ি লন্ডনে ফিরে এসেই সিংহাসনে অভিষিক্ত হলেন এলিজাবেথ। যদিও ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে-তে মহাসমারোহে যে ‘অফিশিয়াল করোনেশন’, ‘অফিশিয়াল মোর্নিং’-এর পর্ব কাটিয়ে তা অনুষ্ঠিত হতে চলে গেল ষোলোটি মাস ১৯৫৩ সালের ২ জুন। কিন্তু ১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি থেকেই দ্বিতীয় এলিজাবেথ হয়ে গেলেন ৭টি কমনওয়েলথ দেশের মহামান্য রানি, এবং ৫৪ সদস্যদেশ-সংবলিত কমনওয়েলথ অব নেশনস-এর প্রধান ব্যক্তি। এই ষাট বছরে কমনওয়েলথ-এর আকারপ্রকার পাল্টেছে, ‘হেড অব কমনওয়েলথ’ অভিধাটির অর্থ ও গুরুত্ব বদলেছে, দিনদুনিয়ার কত নতুন চালচলন দেখা দিয়েছে। কিন্তু রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ থেকে গেছেন। আর তিনটি বছর পার করতে পারলেই তিনি আর এক ঐতিহাসিক ‘মাইলস্টোন’ পেরিয়ে যাবেন রানি ভিক্টোরিয়া। ভিক্টোরিয়া তেষট্টি বছর সাম্রাজ্য শাসন করেছিলেন (১৮৩৮-১৯০১)। ২০২৪ অবধি যদি সুস্থ থাকেন দ্বিতীয় এলিজাবেথ, তবে বিশ্বের সর্বকালের দীর্ঘতম শাসনকালের ইতিহাসও পেরিয়ে যেতে পারেন: যে রেকর্ডটি এত কাল ছিল ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুই-এর। ১৬৪৩ থেকে ১৭১৫: ৭২ বছর রাজা ছিলেন তিনি।
রেকর্ড জিনিসটা প্রধানত সনতারিখ ইত্যাদি বাইরের হিসেবেই ধার্য হয়। কিন্তু যদি তারিখের ভিতরে ডুব দিয়ে ইতিহাসের গভীরে নামার সুযোগ হয়? তা হলে বলাই যায়, দ্বিতীয় এলিজাবেথ-এর নাম ইতিমধ্যেই অদ্বিতীয়। তাঁর নিজের জন্য নয়, তাঁর প্রেক্ষাপটের জন্য। গত ষাট বছরের দ্রুত পরিবর্তনশীলতার মধ্যে যত চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে তাঁর রানিতন্ত্রের প্রেক্ষাপটটির জন্য, আগেকার সব রাজা এবং রানিদের থেকে সেটাই তাঁকে আলাদা করে দেয়। দায়দায়িত্ব তাঁর কিছু ছিল না বললেই চলে, রানি ভিক্টোরিয়া বা রাজা চতুর্দশ লুই যা করেছিলেন বা করতে পারতেন, ইতিহাসে যত আঁচড় কাটতে পারতেন, তার তুলনায় দ্বিতীয় এলিজাবেথ নিতান্তই বেচারি। একটি প্রসাধন-সামগ্রীর মতোই আবশ্যিক কিন্তু গুরুত্বহীন তাঁর অস্তিত্ব। সেটা কম চ্যালেঞ্জ নয়। নিজেকে প্রসাধনবস্তুর মতো নিহিত রাখতে পারা কম কঠিন কাজ নয়। গণতন্ত্রে এই রাজপরিবারের স্থান কোথায় এবং কেন, ইংল্যান্ডের সমাজে এ নিয়ে সংশয় চিরকালই ছিল, কিন্তু দ্বিতীয় এলিজাবেথের সময়েই তা সবচেয়ে বেশি তিক্ত ও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
দেশের মধ্যে যদিও বা কিছু গুরুত্ব তাঁর থেকে থাকে, দেশের বাইরে পা রাখলেই পিতামহ পঞ্চম জর্জ, পিতা ষষ্ঠ জর্জ যেখানে মহামহিম ব্রিটিশ সাম্রাজ্য-কুলতিলক হিসেবে সম্মানিত হয়ে এসেছেন, সেখানে দ্বিতীয় এলিজাবেথ যেটুকু সম্মান পেয়েছেন তার মধ্যেও কি মিশে থাকেনি সাম্রাজ্য-অবসানের পরিহাস, ঔদাসীন্য, এমনকী প্রতিশোধ? ধরা যাক, আয়ার্ল্যান্ডে তাঁর সাম্প্রতিক সফরের কথা। নিকটতম প্রতিবেশী, এক কালের উপনিবেশ, দেশটিতে পা রাখা ইস্তক যে অম্ল-তিক্ততার মুখোমুখি হলেন তিনি, পোশাকি বক্তৃতায় আর ঘরোয়া আলোচনায় তাঁকে বলতেই হল আয়ার্ল্যান্ডের প্রতি কত অন্যায় অত্যাচার করেছে ইংল্যান্ড, ক্ষমা চাইতে হল সাম্রাজ্যের তরফে। কিংবা ধরা যাক, যে কানাডাকে এখনও ব্রিটিশ কমনওয়েলথ তার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ বলে মনে করে, সেখানে রানির হীরকজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত জনমত সমীক্ষায় জানা গেল, ২৪ শতাংশের বেশি মানুষ অবহিতই নন যে তাঁদের সঙ্গে ব্রিটিশ মনার্কির আদৌ কোনও যোগ আছে, অনেকেই এমনকী জানেন না কী সেই মনার্ক-এর নাম। বাস্তবিক, কানাডায় ব্রিটিশ ও ফরাসি দুই যুযুধান অংশের লড়াইয়ের অন্যতম উপজীব্য এত দিন পরেও ব্রিটেন নামক দেশটির সঙ্গে কানাডার রাজনৈতিক সংযোগ কেন। কিন্তু মজার কথা, এই লড়াইয়ের আবহেও দেখা যাচ্ছে, ইংরেজি-ভাষী কানাডিয়ানদের অধিকাংশই বর্তমান রানির নামটাও শোনেননি।
আসলে আগেকার সব সময়কাল থেকে এই ষাট বছরকে যা আলাদা করে দিয়েছে, তার নাম ‘ডি-কলোনাইজেশন’ এবং তার আবশ্যিক সঙ্গী, ‘পোস্ট-কলোনিয়ালিজম’। শতাব্দী-প্রাচীন সাম্রাজ্য-সূর্য অস্ত গিয়েছে, একটির পর একটি দেশ স্বাধীন হয়েছে, পুরনো সাম্রাজ্যের সঙ্গে তারা সম্পর্ক-ছেদের নানা প্রকার-প্রকরণ দেখিয়েছে। উপনিবেশ-অবসান পর্বটির শুরু হিসেবে অবশ্য দেখা হয় ১৯৪৫ সালটিকে: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে যখন মিত্রশক্তি তাদের পুরনো উপনিবেশের ভার বহনে অক্ষম হয়ে এক-একটি দেশকে মুক্তি দিতে শুরু করে। সে হিসেবে বিশ্বযুদ্ধের ঠিক প্রাক্কালে অভিষিক্ত হওয়া সম্রাট ষষ্ঠ জর্জও ইতিহাসের এক অতুলনীয় ওঠাপড়ার সম্যক সাক্ষী। কিন্তু ওঠাপড়ার মধ্যে থাকা এক জিনিস, আর তার দীর্ঘ প্রলম্বিত অভিঘাত সামলানো আর এক জিনিস। সে কাজটা করতে হয়েছে তাঁর কন্যাকেই। সাম্রাজ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, ষষ্ঠ জর্জ যদি ট্র্যাজিক চরিত্র হন, দ্বিতীয় এলিজাবেথ তবে অনুল্লেখ্য বেচারি ছাড়া কিছু নন।
জর্জ বার্নার্ড শ-এর কথা মনে পড়ে। বলেছিলেন: Kings are not born; they are made by artificial hallucination. দুর্ভাগ্য দ্বিতীয় এলিজাবেথের! তিনি রানি হয়ে জন্মালেন, কিন্তু যে সম্মেলক দৃষ্টিবিভ্রম তাঁকে সত্যিকারের রানি বানাতে পারত, সাম্রাজ্য-শেষের বিশ্বদুনিয়া সেই দৃষ্টিবিভ্রম থেকে উত্তীর্ণ হয়ে গেল। বেচারি!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.