অতি সস্তায় চাষিদের থেকে আলু কিনে ভুয়ো নামে হিমঘরে মজুত রাখা হয়েছিল, সরকারি সহায়কমূল্য আদায়ের উদ্দেশ্যে। অনেক ক্ষেত্রে আবার আলু কেনাই হয়নি। খাতায়-কলমে কেনা সেই ‘অস্তিত্বহীন’ আলুও হিমঘরে মজুত ছিল স্রেফ কাগজে-কলমেই।
এবং দু’ক্ষেত্রেই সহায়কমূল্য বাবদ বেরিয়ে গিয়েছে সরকারি কোষাগারের কয়েকশো কোটি টাকা। অথচ যাদের স্বার্থরক্ষায় সহায়কমূল্যের ঘোষণা, সেই আলুচাষিদের অধিকাংশই তার নাগাল পাননি বলে সিআইডি’র তদন্ত-রিপোর্টে ইঙ্গিত মিলেছে। চারশো কোটির ‘আলু-কেলেঙ্কারি’ নিয়ে গত ১১ মে সিআইডি-তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গোয়েন্দা-কর্তারা ইতিমধ্যে প্রাথমিক তদন্ত-রিপোর্ট বানিয়ে ফেলেছেন। শিগগিরই তা স্বরাষ্ট্র দফতরে জমা দেওয়া হবে বলে সিআইডি-সূত্রের খবর। ‘কেলেঙ্কারি’টা কী রকম?
অভিযোগ, ব্যবসায়ীদের একাংশ চাষিদের থেকে সস্তায় আলু কিনে নিয়েছেন। ভুয়ো চাষির নামে হিমঘরে মজুত রাখা সেই আলু সহায়কমূল্যে সরকারকে বিক্রি করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আলুর অস্তিত্ব না-থাকলেও হিমঘরে মজুতের ‘কাগজ’ দেখিয়ে সরকারি দর আদায় হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। হিমঘরে আলু রাখার নথি দেখালে ব্যাঙ্ক (সাধারণত সমবায় ব্যাঙ্ক) চাষিকে ঋণ দেয়। যার সুবাদে গত ক’বছরে হিমঘরে আলু মজুতের ভুয়ো নথি দেখিয়ে কয়েক কোটি টাকা ব্যাঙ্ক-ঋণ নেওয়ারও একাধিক অভিযোগ মিলেছে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক-কর্তৃপক্ষ গিয়ে দেখেছেন, আলু বা চাষি বাস্তবে কিছুরই অস্তিত্ব নেই!
প্রশাসনিক সূত্রের খবর: ২০১০-এর মরসুমে আলুর দাম তলানিতে নেমে গিয়েছিল। চাষিদের দুর্দশা কিছুটা লাঘব করতে ওই বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি তদানীন্তন বাম সরকারের কৃষি দফতর সিদ্ধান্ত নেয়, সহায়কমূল্যে চাষিদের থেকে ৫ লক্ষ টন আলু কেনা হবে। সেই খাতে প্রায় ২৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। বেনফেড, কনফেড ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিগমকে আলু কেনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ৫ মার্চ আলু কেনার লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে দ্বিগুণ, অর্থাৎ ১০ লক্ষ টন করা হয়।
কিন্তু এর পরে বিভিন্ন সংগঠনের তরফে ও সংবাদমাধ্যমে অভিযোগ ওঠে, ভুয়ো চাষির নামে আলু কিনে সহায়কমূল্যের প্রচুর অর্থ নয়ছয় হয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ২০১০-এর ৩০ জুলাই শিল্প পুনর্গঠন দফতরের তৎকালীন সচিব সুব্রত গুপ্তের নেতৃত্বে এক সদস্যের কমিটি গড়ে সরকার। সুব্রতবাবুর রিপোর্টে অভিযোগের সত্যতা কার্যত স্বীকার করা হলেও বাম জমানায় এ নিয়ে আর এগোনো হয়নি। কোনও এফআইআর-ও দাখিল হয়নি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ‘আলু-কেলেঙ্কারি’ নিয়ে ফের নাড়াচাড়া শুরু হয়। হুগলি জেলায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট শুভঙ্কর সরকারকে মাথায় রেখে গড়া হয় জেলাস্তরের একটি তদন্ত কমিটি। গত ২৪ জানুয়ারি শুভঙ্করবাবু দশ পাতার রিপোর্ট কৃষি বিপণন দফতরে জমা দেন। গ্রামের সমবায় সংস্থা থেকে শুরু করে জেলা পরিষদ স্তরেও কী ভাবে আলু কেনার টাকা ‘নয়ছয়’ হয়েছে, রিপোর্টে তার উল্লেখ রয়েছে।
শুভঙ্করবাবুর অভিযোগের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে সিআইডি’র প্রাথমিক রিপোর্টেও।
কী ভাবে?
গোয়েন্দা-সূত্রের খবর: সে সময়ে বাজারে আলুর দর নেমে গিয়েছিল কুইন্ট্যাল পিছু ১২০ টাকায় (১ টাকা ২০ পয়সা কেজি)। ঠিক হয়েছিল, চাষিদের থেকে ৩৫০ টাকা কুইন্ট্যাল (সাড়ে ৩ টাকা কেজি) দরে আলু কেনা হবে। উপরন্তু মজুরি, হিমঘর-ভাড়া, প্যাকেজিং ইত্যাদি মিলিয়ে প্রতি কিলো আলুর পিছনে সরকারের খরচ পড়ে যায় ৪.৮০ টাকা থেকে ৫.৩০ টাকা। কেনা সেই আলু জুলাইয়ের গোড়ায় বাজারে বিক্রি শুরুর কথা থাকলেও সরকার তা করে উঠতে পারেনি। পরে কিলোয় মোটামুটি দু’টাকা লোকসানে, ৩০০ টাকা কুইন্ট্যাল (৩ টাকা কেজি) দরে
আলু বিক্রি আরম্ভ হয়। ক্রমে দর নেমে যায় কুইন্ট্যাল পিছু ২০০ টাকায় (২ টাকা কেজি)। এর পরেও অবশ্য হিমঘরে আলু রয়ে গিয়েছিল। শেষমেশ বিনামূল্যে তা বিলিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন সরকার। তাতেও সব আলু শেষ করা যায়নি।
প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে সিআইডি-কর্তাদের একাংশের দাবি, ২০১০-এর মরসুমে আলু-খাতে সরকারের ঘাড়ে যে আর্থিক বোঝা চেপেছে, তা অভূতপূর্ব। বস্তুত ব্যবসায়ীদের একাংশের যোগসাজশে আলু কেনা-বেচায় সরকারি অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। কিন্তু ২০১০-এর ‘কেলেঙ্কারি’তে বেশ কিছু ‘বড় মাপের’ নেতা-আমলারও জড়িত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে বলে গোয়েন্দাদের একটি মহলের সন্দেহ।
এ বার তাঁদেরও জেরা করতে চাইছে সিআইডি। |