ওরাও সকলে করেছে, লড়েছে এবং জিতেছে। মূল প্রতিপক্ষ দারিদ্র্য। অনেক সময় শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকেও হার মানতে হয়েছে ওদের সামনে।
মৌমিতা খাতুনের বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল ক্লাস নাইনে পড়তেই। দিনমজুর বাবা-মাকে ওই কিশোরী বলেছিল, পড়তে চায় সে। আর নিজেকে বুঝিয়েছিল, একমাত্র শিক্ষাই তার জীবনের দিশা বদলে দিতে পারে। এ বছর মাধ্যমিকে চারটি বিষয়ে লেটার-সহ ৫৪৫ নম্বর পেয়েছে নদিয়ার আঁইশমালির মৌমিতা খাতুন। আঁইশমালি ইউনাইটেড অ্যাকাডেমির ছাত্রী মৌমিতার সাফল্যে খুশি শিক্ষকেরাও। স্কুলে এ বার সেরা সে-ই। মৌমিতা বলে, “আমি বিয়েতে রাজি না হওয়ায় বাবা-মা আর জোর করেনি। তবে স্কুলের শিক্ষক আর বন্ধুদের সাহায্য ছাড়া এমন ফল করতে পারতাম না।” প্রধান শিক্ষক দেবাশিস মুখোপাধ্যায় বলেন, “স্কুলের অনেক মেয়েরই কৈশোরে বিয়ে হয়ে যায়। কেউ প্রতিবাদও করে না। মৌমিতাকেই দেখেছিলাম রুখে দাঁড়াতে। বিয়ে করতে চায় না, সে কথা আমাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল।” মৌমিতারা পাঁচ বোন, এক ভাই। বাবা খলিল মণ্ডল দিনমজুর। দৈনিক আয় মেরেকেটে ৭০ টাকা। ‘গর্বিত’ পিতার কথায়, “অভাবের সংসার বলেই মেয়ের বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। তবে ও সে সময়ে রুখে না দাঁড়ালে এমন দিন আসত না।”
হাওড়ার বাগনানের দেগ্রামের বাসিন্দা শুভ সিংহের বাবা মারা যান ছোটবেলায়। সেই থেকে মা মাধবী পরিচারিকার কাজ করেন। মাসে রোজগার হাজার খানেক। অভাবে বার কয়েক পড়া বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়েছিল শুভর। ডিএমবি হাইস্কুলের শিক্ষকেরা টাকা জোগাড় করে দেন। এই স্কুল থেকেই এ বার মাধ্যমিকে ৫৯৭ নম্বর পেয়েছে শুভ। তার স্কুলে এ বার এটাই সর্বোচ্চ নম্বর। মাধবীদেবী বলেন, “সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। সকলে সাহায্য না করলে ছেলেটা এগোতে পারত না।” বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চায় শুভ। পরিবারটি বিপিএল তালিকাভুক্ত। সরকারি সাহায্যের ১০ হাজার টাকায় ইটের দেওয়ালের উপরে টালির চাল পড়েছে। মাথা-গোঁজার জীর্ণ ঠাঁইটুকুতে এখন বাসা বাঁধছে অনেক স্বপ্ন। |
|
|
|
|
|
মৌমিতা খাতুন |
শুভ সিংহ |
সঙ্গীতা সামন্ত |
চন্দ্রাণী ঘোষ |
অভীক মুখোপাধ্যায় |
|
পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলের গোপালপুরে বাড়ি সঙ্গীতা সামন্তের। বাবা দীনেশবাবু ও মা শ্রীলেখা সেলাইয়ের কাজ করেন। সংসারে হাঁড়ির হাল। এ বার মাধ্যমিকে ৬৫০ নম্বর পেয়েছে গোপালপুর হাইস্কুলের ছাত্রী সঙ্গীতা। সামান্য আয়ের সংসারে নিজের স্বপ্নকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছে সঙ্গীতা। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার বদলে ‘বড় হয়ে’ নিজের স্কুলেই পড়াতে চায় সে। মেয়ের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত বাবা-মা।
দারিদ্র্যের সঙ্গে নিত্য লড়াই করে বেঁচে থাকা। তবু পাটকাঠির বেড়া আর মাটির দাওয়ার ঘরে থেকেই ‘আকাশের চাঁদ’ হাতে পেতে চায় চন্দ্রাণী। হুগলির গুপ্তিপাড়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীটি মাধ্যমিকে এ বার ৬৩৭ নম্বর পেয়েছে। গুপ্তিপাড়ার ঠাকুরপাড়ার বাসিন্দা চন্দ্রাণী ঘোষ চায় বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে। কিন্তু পরিবারের আর্থিক অবস্থার কথা ভাবলেই ভবিষ্যতের স্বপ্নটা ঝাপসা হয়ে আসে। বাবা বিমল ঘোষ খেতমজুর। সংসারের জোয়াল টেনে তিন মেয়ের পড়াশোনা সবই চলে তাঁর সামান্য রোজগারে। সাধ আর সাধ্যের মধ্যে ফারাকটা বিলক্ষণ জানে চন্দ্রাণী। বলে, “কেউ সাহায্য না করলে হয় তো আর পড়াই হবে না!”
বাঁকুড়ার বড়জোড়া হাইস্কুলের অভীক মুখোপাধ্যায় জন্ম থেকেই বধির। শ্রবণ-যন্ত্র লাগিয়েও খুব ক্ষীণ শব্দ শোনে। ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে কথা বোঝার প্রশিক্ষণ নিয়েছিল সে। এ ভাবেই পড়াশোনা চালিয়ে অভীক এ বার ৬০৫ নম্বর পেয়েছে। বসত ক্লাসের সামনের সারিতে। না হলে শিক্ষকদের পড়া কিছুই বুঝতে পারত না ছেলেটি। অনেক সময় ক্লাসে নোট নিতে সহপাঠীরা তাকে সাহায্য করেছে। অভীকের বাবা অশোকবাবু বলেন, “জন্ম থেকেই ছেলেটা শুনতে পায় না। অনেক চেষ্টায় এখন জড়ানো স্বরে কথা বলতে পারছে।”
|
(প্রতিবেদন: সৌমিত্র সিকদার, নুরুল আবসার, দেবমাল্য বাগচি, প্রকাশ পাল, রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
ছবি: সৌমিত্র সিকদার, হিলটন ঘোষ, আরিফ ইকবাল খান, প্রকাশ পাল, অভিজিৎ সিংহ) |