একদা দলের সাধারণ সম্পাদক পি সুন্দরাইয়াকে চিঠি লিখতে হয়েছিল তাঁর নিজের রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশের কর্মীদের উদ্দেশে। দলের অন্দরে কিছু বিতর্কের ব্যাখ্যা দিতে। এখন এমন সময় এসেছে, যখন দলের নেতা-কমর্ীর্রাই পরস্পরের বিরুদ্ধে চিঠি পাঠাচ্ছেন উচ্চ নেতৃত্বের কাছে!
পত্র-বাণের ঠেলায় জেরবার সিপিএম!
আবার ঘটনাচক্রে, চিঠি মারফত ‘গৃহযুদ্ধ’ চলাকালীনই সিপিএম পালন করছে প্রয়াত সুন্দরাইয়ার জন্ম শতবর্ষ!
এমনিতে নেতৃত্বের কাছে চিঠি লিখে বিভিন্ন বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সিপিএম কর্মীদের কোনও বাধা নেই। কিন্তু দলীয় সূত্রের খবর, এই ‘সুযোগ’কে সম্প্রতি কর্মীরা ব্যবহার করছেন ‘অন্য ভাবে’। দলের মধ্যে এক গোষ্ঠীর অনুগামী বলে পরিচিত নেতা-কর্মীরা উচ্চতর নেতৃত্বের কাছে চিঠি পাঠাচ্ছেন তাঁদের বিরোধী গোষ্ঠীর নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে। এত অভিযোগ সংবলিত চিঠি নিরন্তর নানা স্তরের কমিটির কাছে এসে চলেছে, যার সব খতিয়ে দেখতে গেলে সিপিএমকে ২৪ ঘণ্টা শুধু অভিযোগ যাচাইয়ের কাজই করতে হবে! কেরলের রাজ্য সম্পাদক পিনারাই বিজয়নের কাজকর্মের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে বিরোধী দলনেতা ভি এস অচ্যুতানন্দন যেমন এ কে জি ভবনে চিঠি পাঠাচ্ছেন, তেমনই এ রাজ্যে অমিতাভ নন্দীর মতো কারও বিরুদ্ধে চিঠি আসছে আলিমুদ্দিনে।
সিপিএম সূত্রের খবর, রাজ্যে ক্ষমতা হারানোর পর দলের মধ্যে এই পারস্পরিক অভিযোগের ধারা ‘উদ্বেগজনক’ ভাবে বেড়েছে। কর্মীদের যত চিঠি গত এক বছরে উচ্চতর নেতৃত্বের কাছে এসেছে, তার মধ্যে সামান্যই মতাদর্শগত বা রাজনৈতিক বিতর্ক নিয়ে। সিংহভাগই দলের কোনও না কোনও নেতা বা কর্মীর আচরণ, কাজকর্ম বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ। যে সব ঝাড়াই-বাছাই করতেই নেতৃত্বকে এখন অনেকটা সময় দিতে হচ্ছে! অভিযোগ-পত্রের ‘বাধা’ সরিয়ে বিবদমান দুই শিবিরকে এক সঙ্গে বাগে আনতে বেগ পেতে হচ্ছে। আবার অভিযোগের ঠেলায় খোঁজখবর নিতে গিয়ে কোনও কোনও ক্ষেত্রে ‘প্রমাণাভাবে’ নিশ্চুপ হয়ে থাকতে হচ্ছে উচ্চতর নেতৃত্বকে। যেমন যাদবপুরে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের এককালীন বিধানসভা কেন্দ্রের ‘ভোট ম্যানেজার’ খোকন ঘোষ দস্তিদারের বিরুদ্ধে দলে নানা অভিযোগ উঠলেও নির্দিষ্ট কোনও প্রমাণ এখনও মেলেনি বলেই সিপিএম সূত্রের খবর।
লক্ষ্মণ শেঠ, অনিল বসু বা অমিতাভ নন্দীর মতো বাম জমানার এলাকাভিত্তিক ‘দাপুটে’ নেতাদের বিরুদ্ধে দলের কর্মীদের নানা অভিযোগ এসেছে। তার বেশ কিছু অবশ্য ‘প্রমাণসাপেক্ষ’। কিন্তু তার চেয়েও ‘উদ্বেগজনক’ ঘটনা ঘটছে অধুনা বিরোধী দলে। এক রাজ্য নেতার কথায়, “তৃণমূল আমাদের নেতা-কর্মীদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে হেনস্থা করছে বলে অভিযোগ করছি। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এমন ঘটনার নজির মিলেছে, যেখানে দলেরই একাংশ তৃণমূলের সঙ্গে গোপনে যোগসাজস করে অন্য অংশের নামে অভিযোগ বা তথ্য তুলে দিয়েছে!” সিপিএমেরই একাংশের বক্তব্য, যে এলাকায় যে গোষ্ঠীর পক্ষে পাল্লা ভারী, অন্য গোষ্ঠীকে দলের মধ্যে ‘কোণঠাসা’ করতে বা ‘বাইরে থেকে সাহায্য নিয়ে হয়রান’ করতে তাদের তত সুবিধা। দলেরই এক গোষ্ঠীর মাধ্যমে অন্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তথ্য তৃণমূলের হাতে পৌঁছে যাওয়ার ‘প্রবণতা’ পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরে বেশি বলে সিপিএম সূত্রের খবর। দলের এক কেন্দ্রীয় নেতার বক্তব্য, “ক্ষমতায় থাকার সময় সাংগঠনিক স্তরে যে কারণগুলো বিপর্যয় ডেকে এনেছিল, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সেগুলো এখনও দূর করা যায়নি। এ ভাবে চললে সাংগঠনিক ভাবে ঘুরে দাঁড়ানো দূর অস্ত!”
দলে ‘অভিযুক্ত’ নেতারাও তাঁদের মতো করে ‘পত্র-বাণ’ ব্যবহার করছেন। আরামবাগের প্রাক্তন সাংসদ অনিলবাবু যেমন সাসপেন্ড হওয়ার পর চিঠি দেন দলের পলিটব্যুরো সদস্য বুদ্ধবাবুর উদ্দেশে। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁর চিঠিকে বিশেষ গুরুত্ব না-দিলেও বিষয়টি নিয়ে জলঘোলা চলছে। পলিটব্যুরোর এক সদস্য অবশ্য বলছেন, “এ ক্ষেত্রে রাজ্য নেতৃত্বকেই যা করার করতে হবে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এই নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা নেই।” অনিলবাবুর আচার-আচরণে সিপিএমের অন্দরে কিন্তু প্রবল প্রতিক্রিয়া হচ্ছে।
এক যুব নেতার কথায়, “গঠনতন্ত্রে যা-ই থাকুক, সাসপেন্ড-হওয়া এক নেতাকে দলের রাজ্য বা কেন্দ্রীয় নেত্ৃত্বের সঙ্গে এক মঞ্চে দেখা যাচ্ছে এতে কি দল সম্পর্কে খুব ভাল বার্তা যাচ্ছে?” আবার আলিমুদ্দিনের ব্যাখ্যা, অনিলবাবু মঞ্চ বা কর্মসূচিতে থাকলেও তাঁকে বক্তা হিসাবে রাখা হয়নি। তা ছাড়া, চুঁচুড়ায় হুগলি জেলা বামফ্রন্টের কর্মসূচিতে পরপর দু’দিন অনিলবাবু উপস্থিত থাকলেও তাঁর ছবি তো বটেই, নাম পর্যন্ত দলীয় মুখপত্রে লেখা হয়নি। এ থেকেই দলের মনোভাব বোঝা যায়।
অনিল উদাহরণ মাত্র। কোথাও অনিল, কোথাও ভি এস। সিপিএমের ‘বিড়ম্বনা’ জারি আছে! |