সাফল্যের মুখ |
|
দাদার মতো পড়ায় দাঁড়ি চায় না সৌরভ |
এগরার ছত্রি বিবেকানন্দ বিদ্যাভবনের ছাত্র সৌরভ দাস। প্রাপ্ত নম্বর ৬২৯। বাড়ি স্থানীয় আড়িয়াপোতা গ্রামে। বাবা নিত্যানন্দ দাস ও মা সন্ধ্যাদেবী ভাগচাষ ও দিনমজুরি করেন। পড়ার ফাঁকে বাবা-মার সঙ্গে মাঠে গিয়ে কাজও করতে হয় সৌরভকে। দাদা সঞ্জয় কলেজে পড়ে। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সরকারি কলেজে সুযোগ পেলেও অর্থাভাবে সেখানে পড়া হয়নি তার। সঞ্জয় এখন টিউশনি পড়িয়ে নিজের পড়ার খরচ কিছুটা চালান। পরিবারের কেউই চান না সৌরভের জীবনেও এমন কিছু ঘটুক। স্বামী বিবেকানন্দকে আদর্শ মনে করা সৌরভ গল্পের বই পড়তে ভালবাসে। বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় সে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রদীপ দাস বলেন, “স্কুলের শিক্ষকরাই ওর পাশে দাঁড়িয়েছিল। আর্থিক সাহায্য পেলে অনেক বড় হতে পারবে।”
|
দারিদ্রই বাধা দীপঙ্করের স্বপ্নে |
মোহনপুরের বেগুনিয়া ক্ষেত্রমোহন বিদ্যাপীঠের ছাত্র দীপঙ্কর দে। প্রাপ্ত নম্বর ৬১৩। বাড়ি রামনগরের বারবাটিয়া গ্রামে। বাবা শ্রীধর দে নির্মীয়মাণ ফ্ল্যাটে দারোয়ানের কাজ করেন। মা প্রমীলা দেবী দিনমজুরি করেন। ছাত্রাবাসে থেকে পড়া দীপঙ্কর স্বপ্ন দেখে রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনে পড়ার। যে কোনও বই পড়তে ভালোবাসে সে। অধ্যাপনা করাই লক্ষ্য। প্রিয় বিষয় গণিত। প্রধান শিক্ষক শ্রীকান্ত দাস মহাপাত্র বলেন, “আর্থিক অভাবই ওর মেধা বিকাশের প্রধান বাধা। সকলের সহযোগিতা পেলে ওর স্বপ্ন সফল হবে।”
|
অভাবকে জয় করতে চায় জয়ন্ত |
এগরার বাসুদেবপুর হরিপ্রিয়া ইনস্টিটিউশনের ছাত্র জয়ন্ত খাটুয়া। প্রাপ্ত নম্বর ৬০৪। বাড়ি কাঁথির পশ্চিম মানিকপুর গ্রামে। বাবা অমল খাটুয়া ফুসফুসে টিউমারে আক্রান্ত। তবু অর্থের জন্য ফেরি করেন ওড়িশায়। মা কিশোরীদেবী ভাগচাষ ও দিনমজুরি করেন। এই অর্থনৈতিক অবস্থার জন্যই টিউশন নিতে পারেনি জয়ন্ত। স্কুলের শিক্ষকদের কাছে পড়া বুঝে নিয়েছে। বিজ্ঞান প্রিয় বিষয়তার। চিকিৎসক হতে চায় সে। ভালবাসে ক্রিকেট খেলতেও। কোনও ভালো স্কুলে বিজ্ঞান শাখায় পড়তে চায়। প্রধান শিক্ষক তরুণ মাইতি বলেন, “জয়ন্ত মেধাবী। পড়াশোনার ব্যাপারে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য পেলেই অনেক বড় হতে পারবে।”
|
সৌমেনের মেধায় বাধা নয় দারিদ্র |
ভগবানপুরের শঙ্করপুর নারায়ণ বিদ্যাপীঠের ছাত্র সৌমেন দাস। তার প্রাপ্ত নম্বর ৬২৮। বাড়ি স্থানীয় বিভীষণপুর গ্রামে। বাবা মানিকলাল দাস দোকানের কর্মী। মা রীনাদেবী ও কাকা রতনলাল ভাগচাষ ও দিনমজুরি করেন। পড়ার ফাঁকেই অভাবের সংসারে মা-কাকার কাজে সাহ্যয্য করেছে সৌমেন। গ্রামের এক শিক্ষক অর্থ না নিয়ে তাকে পড়িয়েছেন। প্রিয় বিষয় গণিত। চিকিৎসক হতে চায় সে। তারও আগে চায় নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে। ক্রিকেট তার পছন্দের। স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিমাদ্রিশেখর খাটুয়া বলেন, “সৌমেন মেধাবী, দরিদ্র ও বিনয়ী। ওর মেধার বিকাশ ঘটাতে আর্থিক সহায়তা ও পড়ার সুস্থ পরিবেশ চাই।”
|
দারিদ্র নিয়ে শঙ্কায় অলোক |
দারিদ্র্যের সংসার। আড়াই বিঘে মতো জমি রয়েছে। সেই জমি চষে সংসার চলে। এর মধ্যে থেকেও লড়াই ছাড়েনি অলোক মাহাতো। লড়াই দারিদ্র্যের সঙ্গে। শালবনি থানার মৌপাল দেশপ্রাণ হাইস্কুলের এই ছাত্র মাধ্যমিকে ৫৯৬ নম্বর পেয়েছে। অলোকদের বাড়ি নোনাশোলে। বাবা অজিত মাহাতো চাষবাস করেন। ঘরে পাতা সেলাইয়ের মেশিনও রয়েছে। মা লক্ষ্মীদেবী গৃহবধূ। বোন অলোকা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। মেদিনীপুর শহরের একটি স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হতে চায় অলোক। তার কথায়, “আরও ভাল ফল আশা করেছিলাম। উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল ফল করতে চাই।” ভবিষ্যতে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় নোনাশোলের এই ছাত্র। ছাত্রের এই সাফল্যে খুশি মৌপাল দেশপ্রাণের প্রধান শিক্ষক প্রসূন পড়িয়া বলেন, “ও খুব ভাল ছাত্র। আমাদের শুভেচ্ছা থাকল।” ছেলের উচ্চশিক্ষার পথে দারিদ্র্য বাধা হয়ে দাঁড়াবে না তো, এই প্রশ্নটা যেন ঘুরপাক খাচ্ছে অজিতবাবুদের মনে।
|
কষ্টের মধ্যেও পড়া চালাতে চায় বুদ্ধদেব |
বাবা রবীন্দ্রনাথ দাস দোকানে কাজ করেন। মাসে আয় ১৮০০ টাকা। স্বভাবতই অভাবের সংসার। তারই মধ্যে থেকে এ বার মাধ্যমিকে ৫৬৭ নম্বর পেয়েছে বুদ্ধদেব দাস। বাড়ি মেদিনীপুর শহরের বল্লভপুরে। পারিবারিক কারণে সুজাগঞ্জের ভাড়া বাড়িতে দিন কাটে। ভাড়া বলতে বাবা যে দোকানে কাজ করেন, তার মালিকই এখানে থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। মা দিপালীদেবী গৃহবধূ। ছোট থেকেই মেধাবী মেদিনীপুর টাউন স্কুলের এই ছাত্র। সে বলে, “স্কুল থেকে অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। পরিচিতদের মধ্যে কেউ বই, কেউ ব্যাগ দিয়েছেন। কষ্টের মধ্যেও পড়াশোনা চালিয়ে যাব। উচ্চমাধ্যমিকে আরও ভাল ফল করার চেষ্টা করব।” কলা বিভাগেই পড়তে চায় বুদ্ধদেব। সে বলে, “বড় হয়ে কী হব এখনও ভাবিনি। তবে সবার আগে মানুষ হতে চাই। সুযোগ এলে গরিব মানুষকে সাহায্য করতে চাই।” টাউন স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিবেকানন্দ চক্রবর্তী জানালেন, ও মেধাবী ছাত্র। দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও নিজের জোরেই এই ফল করেছে।
|
সঞ্চিতার ফল হাসি ফুটিয়েছে সংসারে |
অভাবের সংসারে মেয়ের মাধ্যমিক ফলই যেন হাসি ফুটিয়েছে। খড়্গপুর লোকাল থানার তেলিপুকুর হাইস্কুলের ছাত্রী সঞ্চিতা মান্না মাধ্যমিকে প্রাপ্ত নম্বর ৬১২। তার কথায়, “ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে রয়েছে। জানি না কী হবে। তবে আমি মেডিক্যালে সুযোগ পাওয়ার চেষ্টা করব।” চিকিৎসক হয়ে গরিব মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায় কৃতী ছাত্রীটি। সঞ্চিতাদের বাড়ি কালিয়াড়া ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের চোরখি গ্রামে। বাবা সহদেব মান্না চাষবাস করেন। বিঘা দেড়েক জমি রয়েছে। মা বীণাপাণিদেবী গৃহবধূ। ভাই সনৎ দশম শ্রেণিতে পড়ে। সঞ্চিতা বলে, “স্কুল থেকে সহযোগিতা পেয়েছি। তবে ভেবেছিলাম, আরও কিছুটা বেশি নম্বর পাব। ৬২০- র মতো।” তেলিপুকুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক চণ্ডীচরণ ত্রিপাঠির কথায়, “আমাদের সকলের শুভেচ্ছা থাকছে। ও আরও বড় হবে।” পরিবারের আশা, উচ্চশিক্ষার পথে বাধা এলে সহৃদয় মানুষ নিশ্চয়ই সহযোগিতা করবেন।
|
স্কুলের কাছে ঋণী শুকদেব |
অনটন নিত্যসঙ্গী। বাবা শুকদেব অধিকারী আগে এক সংস্থায় কাজ করতেন। এখন গৃহশিক্ষকতা করেন। প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের পড়ান। সেই আয়েই সংসার চলে। অভাবের মধ্যে পড়াশোনা করেই মাধ্যমিকে ৬২৫ নম্বর পেয়েছে মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র শুকদেব অধিকারী। মা জয়ন্তীদেবী গৃহবধূ। ভাই শুভদীপ নবম শ্রেণিতে পড়ে। বাড়ি মেদিনীপুরের বল্লভপুরে। কষ্ট করেই দুই ছেলের পড়ার খরচ চালান জয়দেববাবু। বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়ে চায় শুকদেব। তার কথায়, “ভবিষ্যতে কী হব, তা এখনও ভাবিনি। তবে জয়েন্ট দেব।” পড়া চালাতে মাঝেমধ্যে সমস্যা হয়েছে। তখন শিক্ষক ও পরিচিতরাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ সেই পঞ্চম শ্রেণি থেকে তার কাছ থেকে কোনও ফি নিত না। শুকদেবের কথায়, “স্কুলের এই সহযোগিতা ভুলতে পারব না।” কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক দিলীপ দাসের আশ্বাস, “আমরা আগামী দিনেও ওর পাশে থাকব।”
|
|