চৌষট্টি খোপের একটা খেলায় টানা পাঁচ বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা কী জিনিস, আমরা হয়তো এখন বুঝব না। যত সময় যাবে, ভারতীয় দাবার দুনিয়া উপলব্ধি করবে এর তাৎপর্য।
ছোটবেলায় আমরা যখন দাবা খেলতে শুরু করেছিলাম, বারবার শুনতাম ‘সোভিয়েত স্কুল অব চেস’ ব্যাপারটা। দাবার জগতে এর একাধিপত্যের কথা। করপভ-কাসপারভের সেই জমানা থেকে বিশ্ব দাবা যে অনেকটাই মুক্ত, তার পিছনে কিন্তু বিশ্বনাথন আনন্দ। আমাদের আনন্দের জন্যই বিশ্ব দাবায় ভারত একটা বড় শক্তি। সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার আটের দশকের মতো পাড়ায় পাড়ায় দাবা স্কুল এখনও গড়ে ওঠেনি, ওদের তুলনায় এখনও পিছিয়ে আমরা। কিন্তু ভারতীয় দাবাড়ু মাত্রেই এখন বিদেশের টুর্নামেন্টে কল্কে পেয়ে থাকে। আনন্দের আবার চ্যাম্পিয়ন হওয়া মানে নতুন প্রজন্মের কাছে ফের একটা দৃষ্টান্ত। সামনে আনন্দের মতো রোল মডেল, দাবায় আমাদের আরও না এগনোর কারণ নেই। |
ম্যাচের কথায় আসি। সত্যি কথা বলতে গেলে অভিনবত্বের দিক থেকে আনন্দ-গেলফাঁ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে এমন কিছু পাওয়া যায়নি, যা নিয়ে দাবা দুনিয়া গবেষণায় ব্যস্ত হয়ে পড়বে। উদ্ভাবনী যুগান্তকারী চাল ছিল না একেবারেই। সহজ ওপেনিং দিয়েও কী ভাবে গেমকে জটিল করে তার রহস্যভেদে প্রতিপক্ষকে ব্যস্ত করে তোলা যায়, তার নানা উদাহরণ কিন্তু বারোটা গেমে ছিল। সেখানে বরং ছিল বৈচিত্র্য। সে জন্যই দশটা গেম ড্র হলেও দাবাপ্রেমীরা বিরক্ত হননি। ২০১০-এর আনন্দ-টোপালভ খেতাবি ম্যাচে পাঁচটা গেমে ফলাফল হয়েছিল। এ বার মাত্র দুটো গেমে ফলাফল হলেও লড়াই প্রতি মুহূর্তে ছিল হাড্ডাহাড্ডি। আমি বরং বারো গেমের ম্যাচে গেলফাঁকে বেশি কৃতিত্ব দেব, কারণ ফেভারিট ও চার বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হিসেবে শুরু করা আনন্দকে ও বারো নম্বর গেম এবং তার পরে টাইব্রেকার পর্যন্ত নিয়ে যেতে পেরেছে।
বারো গেমের ম্যাচে গেলফাঁর বড় ভুল বলতে একটাই। আট নম্বর গেমে। সাত নম্বর গেমে এগিয়ে যাওয়ার পরে ধরেই নেওয়া হয়েছিল আনন্দের পক্ষে সমতা ফেরানো সম্ভব নয়। কিন্তু অষ্টম গেমে বাচ্চাদের মতো একটা ভুল করে আনন্দকে জেতার সুযোগ করে দেয় গেলফাঁই। ওই ধরনের ভুল বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের মতো আসরে একেবারেই প্রত্যাশিত নয়। ওই যে আনন্দ ফিরে এল, তার পরে ওর উদ্দেশ্যই ছিল টাইব্রেকার পর্যন্ত ম্যাচটাকে টেনে দেওয়া। ঠিক সেটাই হয়েছে।
টাইব্রেকারে যেহেতু সময় একটা খুব বড় ফ্যাক্টর, খুব দ্রুত চাল দিতে হয়, সে জন্য কিছুটা এগিয়ে ছিল আনন্দ। কিন্তু প্রথম গেমটায় দু’জনেই এত টেনশনে ছিল যে তুল্যমূল্য খেলা হয়েছে। দ্বিতীয় গেমটায় রাজার সামনের ঘরে বোড়েকে এক ঘর এগিয়ে দিয়ে কিংস পন ওপেনিংয়ে শুরু করেছিল আনন্দ। এর আগে বারোটা গেমের মধ্যে কিংস পন ওপেনিং আনন্দ বারোটার মধ্যে মাত্র তিনটেতে খেলেছে। বাকিগুলো মন্ত্রীর সামনের বোড়েকে এগিয়ে দিয়ে খেলা।
টাইব্রেকারের দ্বিতীয় গেমটায় আনন্দের কিংস পন ওপেনিংয়ের পাল্টা হিসেবে সিসিলিয়ান ডিফেন্সের রাস্তায় গিয়েছিল গেলফাঁ। আনন্দ সেখানে কাজে লাগায় রোজোলিমো পদ্ধতি। এখানে ম্যাচটা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এই পদ্ধতিতে আনন্দের শিবিরের প্রস্তুতি ভীষণ জমাট ছিল। গোটা ম্যাচটায় শুরু থেকেই আনন্দের প্রাধান্য ছিল। সব কিছু চলছিল অঙ্ক ও পরিকল্পনামাফিক। গেলফাঁ হয়তো ম্যাচটা ড্র রাখতে পারত, কিন্তু টাইম প্রেসারে পড়ে পারেনি। টাইব্রেকারে দ্বিতীয় গেমটায় এগিয়ে গেলেও তৃতীয়য় গেমটায় কালো ঘুঁটি নিয়ে চাপে পড়ে যায় আনন্দ। একটা সময় তো দেখছিলাম, বিশেষজ্ঞরা ধরেই নিয়েছিলেন ম্যাচটা জিতে যাচ্ছেন গেলফাঁ। ২৫ নম্বর চালে আনন্দের ই-৫ চালটা মোক্ষম বলে ধরা হচ্ছে। ওই চালটা প্রশংসিত হচ্ছে, কারণ ওখান থেকেই ম্যাচ চলে যায় ড্রয়ের দিকে। আবার সমালোচিত, কারণ গেলফাঁ ওই চালটা ঠিকঠাক ধরতে পারলে আনন্দ হেরে যেত ম্যাচটা। চাপের মুখে চালটাই চোখে পড়েনি গেলফাঁর। আমি বলব, কিছুটা হলেও ভাগ্য আনন্দের সঙ্গী ছিল এ দিন। নয়তো তিন নম্বর গেমটায় ওভাবে নিশ্চিত হার বাঁচত না। তবে ভাগ্য তো সাহসীদেরই সহায় হয়। এত বড় চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচে কোথাও না কোথাও একটু ভাগ্যের সাহায্য লাগেই। কিন্তু সেটা নিয়ে এখন আর মাথা ঘামানোর মানে হয় না। বিশ্ব দাবায় এখন আধুনিক ধারণা হল, যা করার কুড়ি থেকে ত্রিশ বছরের মধ্যে করে ফেলতে হবে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সেটাই আদর্শ বয়স হিসেবে ধরা হচ্ছে। সেখানে চল্লিশ পেরিয়েও চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা এক কথায় অবিশ্বাস্য কৃতিত্ব। সেলাম আনন্দ। |