দেশে বেশির ভাগ মানুষই বৃদ্ধাবস্থায় সম্পূর্ণ অসহায়। ‘কেয়ার ইকনমি’-তে তাঁদের প্রবেশাধিকার নেই।
কিন্তু, তাঁদের জন্য পেনশনের দাবি জানালেই সমাজ আপত্তি করে। লিখছেন
অচিন চক্রবর্তী |
বিশ্বনাথবাবু, শশীঠাকুরুণ, পবন এঁরা এখনকার সরকারি ভাষায় যাকে বলে ‘সিনিয়র সিটিজেন’। প্রথম দু’জনকে পাই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জন্ম ও মৃত্যু’ গল্পে। আর নিবারণের বাবা পবনকে পাই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘গরম ভাত অথবা নিছক ভূতের গল্প’-তে। কুঞ্জ বাড়ি ভাড়ার খোঁজে বিশ্বনাথবাবুর ভবানীপুরের বাড়িতে এসে পড়ে। সে দিন সাতাত্তর বছর বয়সি বিশ্বনাথবাবুর জন্মদিন। ফুলের তোড়া নিয়ে অভিনন্দন জানাতে কত যে ছেলে-মেয়ে, তরুণ-তরুণী, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া ঘরটায় ঢুকতে-বেরুতে লাগল। বিশ্বনাথবাবুর সস্নেহ হাসিমুখে পরিতৃপ্তির ছাপ। সবাই তাঁর আত্মীয়। ছেলে-মেয়ে-জামাই-নাতি-নাতনি। কুঞ্জ অবাক। বেরিয়ে আসছে। বন্ধুু নিবারণ মিত্রের সঙ্গে দেখা, এ পাড়ায় থাকে। বন্ধু হেসে বলে, খুব আশ্চর্য লাগছে? আসল কথা কী জানো, বুড়োর হাতে হাজার পঞ্চাশ ষাট টাকা আছে। সকলেরই চোখ সে দিকে এ কথা যদি বলি, তবে সেটা খুব খারাপ শোনাবে হয়তো কিন্তু কথাটা মনে না-উঠে কি পারে?
এর পর কুঞ্জ যায় নিজের গ্রামে। শোনে বৃদ্ধা শশী ঠাকুরুণ মারা গিয়েছেন। একটা চালাঘরে তিনি পড়ে থাকতেন। বড় ছেলেই তাঁর ভরণ-পোষণ করত বটে, কিন্তু তেমন আগ্রহ নিয়ে করত না। ‘অর্থাৎ তার মনের মধ্যে এই ভাবটা জেগে রইত যে, মা তো আমার একার নয়। সকলেরই তো কিছু কিছু সাহায্য করা উচিত মাকে। অন্য ছেলেরা কখনও সন্ধান নিত না বুড়ি বাঁচল কি মোলো, অথচ সকলেরই অবস্থা ভাল।’ শশী ঠাকুরুণ মারা গেলে পর ছেলেরা সপরিবার বাড়ি আসে। ঘটা করে মায়ের শ্রাদ্ধ করে।
সমাজবিজ্ঞানের ছাত্ররা যাকে বলে ‘কেস স্টাডি’। এ যেন তা-ই। দু’রকম দুটি কেসকে পাশাপাশি রেখে বিভূতিভূষণ যেন ‘কেয়ার ইকনমি’র রূঢ় বাস্তবখানি চিহ্নিত করেছেন কয়েকটি আঁচড়ে। কেয়ার ইকনমিতে শশী ঠাকুরুণের কোনও ‘অ্যাকসেস’ই নেই। কারণ, তাঁর টাকা নেই। কাঁসার বাটিটা বেচতে নাপিত বাড়ি গিয়ে শুকনো মুখ ফিরে আসেন। কারণ, নাপিত নগদ টাকা দিতে পারবে না বলেছে। বিশ্বনাথবাবুর সে ভাবনা নেই। জন্মদিনে ফুলের তোড়া হাতে পরিবার এমন সৌভাগ্য ক’জনের হয়? হয় না বলেই তো সরকারকে শেষমেশ আইন পাশ করতে হল মেনটেনান্স অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অব প্যারেন্টস অ্যান্ড সিটিজেন অ্যাক্ট, ২০০৭। এই আইনের ফলে এখন সন্তানরা বাবা-মার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে বাধ্য। না-নিলে শাস্তি হতে পারে। বাবা-মা ছেলের নামে সম্পত্তি লিখে দেওয়ার পর ছেলে যদি বাবা-মাকে তাড়িয়ে দেয়, আইনের সাহায্যে সে সম্পত্তি বাবা-মা ফিরে যেতে পারেন।
কিন্তু এ আইন পবনদের কোন কাজে আসবে? বর্ষিষ্ঠ নাগরিকদের মধ্যে তো পবনরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ‘গরম ভাত’ গল্পে নিবারণ তার পোয়াতি বউ আর পান্তি-গেনুর জন্য দু’মুঠো জোটাতে পারলে হয়তো বাপটাও পায়। শশী ঠাকুরুণের রোজগেরে ছেলেদের মতো বাপটাকে মেরে ফেলতে পারেনি নিবারণ। কিন্তু ধারকর্জ করে কয়েকটি কপির চারা যা লাগিয়েছিল বৃষ্টিতে যখন তা পচে গেল, যে মাটি কাটার কাজ অন্তত একদিন অন্তর জুটছিল তাও যখন বন্ধ হল, ক্ষুধায় টলতে টলতে বাড়ি ঢুকে সব্বাইকে তার লাথি কষাতে ইচ্ছা করে। খালিপেটে ঘুম আসে না। বাপ পবনেরও না। ও দিকে সুরেন্দ্র দল হেঁকে যাচ্ছে, একটা ভূত ধরে দিতে পারলেই একশো টাকা। নিদারুণ মোড় নেয় গল্প। নিবারণ বলল, বাবা তুমি মলে... পবন বলে, হ্যাঁ ভূত হব নিশ্চয়ই... সুরেন্দ্রকে ডেকে আনিস... আমি বোতলে ঢুকে যাব... তার পরেই চিৎকার ও কান্না মিশিয়ে সে বলে ওঠে, ও বাবা নেবারণ, আমাকে মারিস না, আর দুটো দিন অন্তত বাঁচতে দে...একটু গরম গরম ভাত দিস...।
এমন কোনও নীতি কি হয় না যা শশী ঠাকুরুণ থেকে পবন সকলেরই কথা ভেবে প্রণীত হতে পারে? ‘একশো দিনের কাজ’-এ নিবারণের কয়েক দিন কাজ জুটে গেলেও সে তার পোয়াতি বউটাকে খাওয়াবে, না তার বাপকে, এই ভেবেই দিশাহারা হয়। মূল প্রয়োজনটি যেহেতু ন্যূনতম অর্থের, অতএব সর্বজনীন পেনশনের ব্যবস্থাই তো সরল সমাধান হতে পারে। এ মাসের সাত থেকে এগারো দিল্লির যন্তর মন্তরে সারা দেশ থেকে আগত প্রায় তিন হাজার শশী ঠাকুরুণ আর পবনরা ধর্নায় বসেছিলেন এই পেনশনের দাবিতে। ‘পেনশন পরিষদ’-এর সংগঠক যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন অরুণা রায়, বাবা আধব, জঁ দ্রেজ-এর মতো ব্যক্তিরা।
অন্তত পবনদের মতো মানুষদের জন্য এক রকম পেনশনের ব্যবস্থা অবশ্য আছে। বিপিএল কার্ডধারী পরিবারভূক্ত ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য মাসিক ২০০ টাকার ‘জাতীয় বয়স্ক পেনশন প্রকল্প’ রয়েছে। রাজ্যে রাজ্যে টাকার অঙ্কটা কিছুটা কমবেশি। কিন্তু ক’জনই বা পায় তা? বর্তমানে দেশে ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা মোটামুটি দশ কোটি। অথচ সরকারি হিসাব অনুসারেই পেনশন প্রাপকের সংখ্যা মেরেকেটে দেড় কোটি (এই পরিসংখ্যান নিয়ে সরকারি সূত্রেই যথষ্ট বিভ্রান্তি রয়েছে)। ভারতবর্ষে মোট পরিবারগুলির এক তৃতীয়াংশ বি পি এল কার্ডধারী। যদি অনুমান করে নিই বয়স্কদের মধ্যেও বিপিএলভুক্তির অনুপাত এক/তিন, এবং বিপিএল কার্ডধারীরা প্রকৃত বিপিএল। তা হলে, অন্তত সাড়ে তিন কোটি বয়স্কের তো পেনশন পাওয়া উচিত। প্রকৃত দরিদ্র বয়স্কদের সংখ্যা যে এর চেয়ে বেশি তা আন্দাজ করা যায়। রয়েছেন শশী ঠাকুরুণরা, যাঁদের পরিবার বিপিএল না-হলেও তাঁরা নিজে হতদরিদ্র। সব মিলিয়ে তা হলে দাঁড়াল এই যে বিশ্বনাথবাবুদের মতো কিছু মানুষকে বাদ দিলে বয়স্কদের প্রায় নব্বই শতাংশেরই প্রয়োজন পেনশন। তাঁদের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে এই যুক্তিতেই সর্বজনীন পেনশনের দাবি তুলেছে পেনশন পরিষদ। আর ২০০ টাকা? কী হয় এতে? খোদ গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ বলেছেন, এ তো বয়স্কদের অপমান। তিনি চান ওটা ৫০০ টাকা হোক। পেনশন পরিষদ চাইছে ২০০০ টাকা। কারণ, ন্যূনতম মজুরির অন্তত অর্ধেক তো হতে হবে পেনশনের হার।
এই দু’হাজার শুনেই অনেকের চোখ কপালে উঠেছে। বিশেষত যারা করদাতাদের কষ্টার্জিত অর্থের অপব্যবহারে সদাশঙ্কিত। হিসেব কষে দেখা যায় সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় মাথাপিছু মাসিক ২০০০ টাকা হিসেবে বার্ষিক খরচ দাঁড়াবে তিন লক্ষ ষাট হাজার কোটি টাকা। এটা কি অনেক টাকা? একটু আন্দাজ পাওয়ার চেষ্টা করা যাক। জিডিপি অর্থাৎ মোট জাতীয় উৎপাদনের চার শতাংশ। বর্তমানে ভারত সরকার সামাজিক সুরক্ষা খাতে খরচ করে জিডিপি-র দুই শতাংশের মতো। তার মধ্যে সিংহভাগটাই চলে যায় খাদ্যে ভর্তুকিতে আর মহাত্মা গাঁধী জাতীয় কর্মসংস্থান নিশচয়তা প্রকল্পে। অর্থাৎ এই পেনশন ব্যয় যুক্ত হলে সামাজিক সুরক্ষায় সরকারি ব্যয় দাঁড়ায় জাতীয় আয়ের ছয় শতাংশে। দুই থেকে এক লাফে ছয় শতাংশে নিয়ে যাওয়া সহজ নয়। আর তা ছাড়া কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্পকে যে ভাবে কাঠগড়ায় তোলা হয় যখন তখন বোঝা যায় আপত্তিটা কোন দিক থেকে আসবে। প্রধান প্রতিবন্ধকতা কিন্তু অর্থের নয়, মানবিকতার। মনে রাখতে হবে, টুজি স্পেকট্রাম বণ্টনে সরকারের যা ক্ষতি হয়েছে, তা ১০০ দিনের কাজ-এর বাজেটের তিন গুণেরও বেশি। সম্প্রতি আবার উদ্ঘাটিত হয়েছে কয়লাখনি কেলেঙ্কারি। অকশন ছাড়া লিজ দিয়ে যে ক্ষতি হয়েছে তা টুজি-র পরিমাণকেও ছাপিয়ে গেছে। দারিদ্র দূরীকরণে বাজেটে যখন দু-চার কোটি বাড়ানো হয়, বলা হয়, ‘জনমোহিনী বাজেট’। যাঁরা বিশ্বাস করেন গরিব মানুষরা না-খেটে পয়সা পেলে দেশটা রসাতলে যাবে, তাঁরা আপত্তি তুলবেনই। খেটে খেতে পারো না? অথচ কী আশ্চর্য, পরিসংখ্যান বলছে, এ দেশে ষাটোর্ধ্ব পুরুষদের প্রায় চল্লিশ শতাংশ কিন্তু গ্রাসাচ্ছদের জন্য খেটেই চলছেন। গ্রামাঞ্চলে তাঁদের সংখ্যা আরও বেশি। পৃথিবীর যে কোনও উন্নত দেশেই কিন্তু এই হার যথেষ্ট কম। যদিও সে সব দেশে গড় আয়ু আমাদের থেকে অন্তত দশ বছর বেশি। অনেকে হয়তো বলবেন অবসর নিয়ে বসে না- থেকে কাজকর্মের মধ্যে থাকা তো ভালই। তাই বুঝি? যে চল্লিশ শতাংশের কথা বললাম, এঁদের সিংহভাগই কিন্তু নিরক্ষর। এঁদের জন্য নিশ্চয়ই রাষ্ট্রপুঞ্জে ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্ট-এর পদ অপেক্ষা করে নেই। যে পদে রিটায়ার্ড বাবুদের কদর আছে। বোঝাই যায় এই নিরক্ষর, ভগ্নস্বাস্থ্য মানুষগুলি খেটে যাচ্ছেন শুধুই পেটের তাগিদে। যে পেটও তাঁরা পুরোপুরি ভরাতে পারেন না। শিক্ষার অধিকার আইন প্রসঙ্গে অমর্ত্য্য সেন বলেছিলেন, প্রশ্নটা আইনের নয়, সভ্যতার। সর্বজনীন পেনশন প্রসঙ্গেও বলা যায়, এটা সভ্যতার প্রশ্ন।
|
ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, কলকাতা-য় অর্থনীতির শিক্ষক |