|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
গোড়ায় গলদ, তাই টাকার দাম পড়ছে |
সরকার যতই আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিক, টাকা কমজোরি হওয়ার আসল কারণ অন্য।
অবাধ বাজারের রাস্তায় হাঁটলেই সব সমস্যার সমাধান হবে না। আলোচনা করছেন
অভিরূপ সরকার |
দ্রুত পড়ে যাচ্ছে টাকার দাম। অর্থাৎ, টাকার নিরিখে ডলারের দাম বাড়ছে। দেখতে দেখতে পঞ্চাশ থেকে বাহান্ন, বাহান্ন থেকে চুয়ান্ন, চুয়ান্ন থেকে পঞ্চান্ন; এই লেখা যখন লিখছি, তখন এক মার্কিন ডলারের দাম ছাপ্পান্ন টাকা ছুঁয়েছে। অবমূল্যায়নের ধাক্কাটা যদি শুধুমাত্র সমাজের উপরতলার গুটিকতক মানুষের ওপর পড়ত, যদি এর কুপ্রভাব কতিপয় বিত্তবান বিদেশ ভ্রমণেচ্ছু কিংবা বাড়ির পয়সায় বিলেত-আমেরিকায় পড়তে যাওয়া দু-চার জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, তা হলে বিষয়টা নিয়ে এত দুশ্চিন্তার কিছু ছিল না। কিন্তু, টাকার দাম ক্রমশ কমতে থাকার ফলে ইতিমধ্যেই পেট্রোলের দাম এক ধাক্কায় প্রায় আট টাকা বেড়ে গেছে। কাজেই ছাপোষা মানুষ, শ্রমিক-কেরানি-মাস্টার-ফেরিওয়ালা, কেউই টাকার অবমূল্যায়নের কুফল থেকে নিস্তার পাচ্ছেন না। ইতিমধ্যেই তেলের দাম বাড়ার প্রতিবাদে মিছিল, চাক্কা জ্যাম, ভারত বন্ধ ইত্যাদি ঘোষিত হয়ে গেছে। তেলের দাম বাড়ার মূল কারণ যেহেতু টাকার দাম কমা, যেহেতু এখন এক ডলারের পেট্রোল কিনতে গেলে পঁয়তাল্লিশ টাকার বদলে পঞ্চান্ন টাকা দিতে হচ্ছে, তাই টাকার অবমূল্যায়নের কারণগুলো জানা দরকার। বোঝা দরকার, ঠিক কী কী করলে অবমূল্যায়ন থামানো যেতে পারে। |
|
অভিযোগের আঙুল। পেট্রোলের দাম বাড়ার বড় কারণ টাকার অবমূল্যায়ন।
|
ডলারের দাম বাড়ে কেন? |
বাজারের আর পাঁচটা জিনিসের মতো টাকা-ডলারের বিনিময় মূল্যও নির্ভর করে চাহিদা ও জোগানের ওপর। টাকার নিরিখে ডলারের দাম বাড়ছে, মানে টাকা-ডলার বিনিময়ের বাজারে চাহিদার তুলনায় ডলারের জোগান কমছে। টাকার সঙ্গে ডলার বিনিময়ের একটা বড় সূত্র আমদানি ও রফতানি। যিনি আমদানি করছেন, তিনি টাকা দিয়ে ডলার কিনতে চাইছেন; যিনি রফতানি করছেন, তিনি ডলার উপার্জন করে টাকার বিনিময়ে সেই ডলার বিক্রি করছেন। আমদানির তুলনায় রফতানি কম হতে থাকলে ডলারের চাহিদা তার জোগানের থেকে বাড়তেই থাকবে, ফলে বাজারের নিয়মে টাকার দাম কমে যাবার প্রবণতা দেখা দেবে। এই প্রবণতা ঠেকানো যেতে পারে, যদি অন্য কোনও সূত্রে ডলার পাওয়া যায়।
আমদানি এবং রফতানি মূল্যের মধ্যে তফাতের পোশাকি নাম আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ঘাটতি। সাধারণত এই ঘাটতির কিছুটা মেটানো হয় অনাবাসী ভারতীয়দের বিদেশ থেকে পাঠানো ডলার দিয়ে, কিছুটা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত ডলার দিয়ে, খানিকটা আবার বিদেশি ঋণ কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে খয়রাতি হিসেবে পাওয়া অর্থ দিয়ে। বছরের পর বছর ধরে ভারতের মোট আমদানির মূল্য রফতানি মূল্যের থেকে বেশি হয়ে আসছে। সমস্যা হল, ইদানীং এই দুইয়ের ফারাকটা খুব বেড়ে গেছে। ২০০০-০১ সালে যেখানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৫.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১১-১২ সালের প্রথম ছ’মাসেই ঘাটতি হয়েছে ১৩৩.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ঘাটতির পরিমাণ এখন এতটাই বেড়ে গেছে যে, ঋণ, খয়রাতি, বিনিয়োগ কিংবা অনাবাসীদের পাঠানো ডলার, সব কিছু মেলালেও তা মেটানো যাচ্ছে না। এখন ঘাটতি মেটানোর মূল রাস্তা বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ। আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে, বিদেশি ব্যাংক, পেনশন ফান্ড, মিউচুয়াল ফান্ড ইত্যাদির হাত দিয়ে যে কোটি-কোটি ডলার ভারতীয় শেয়ার বাজারে প্রতি বছর ঢুকছে, তা দিয়েই মেটানো হচ্ছে বাণিজ্য ঘাটতি। বস্তুত, এই কিছু দিন আগেও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি ডলার শেয়ার বাজার দিয়ে দেশে ঢুকছিল। ফলে, কমা দূরের কথা, একটু একটু করে বাড়ছিল টাকার দাম। গত জানুয়ারি মাসে দুই বিলিয়ন এবং ফেব্রুয়ারি মাসে পাঁচ বিলিয়ন ডলার শেয়ার বাজারে ঢুকেছিল। ফলে, জানুয়ারির গোড়ায় যে ডলারের দাম উঠেছিল একান্ন-বাহান্ন টাকায়, ফেব্রুয়ারিতে সেটা গিয়ে দাঁড়াল ঊনপঞ্চাশ টাকার নীচে।
সমস্যা হল, শেয়ার বাজারের বিনিয়োগ ঘোর অনিশ্চিত। তার ওপর নির্ভর করে টাকাকে স্থিতিশীল করা যায় না। মার্চ থেকে ভারতীয় শেয়ার বাজারে বিদেশি বিনিয়োগ কমতে শুরু করল, আর এপ্রিলে পৌঁছে সেই বিনিয়োগ হয়ে গেল ঋণাত্বক। অর্থাৎ, আর নতুন করে ডলার তো ঢুকলই না, উল্টে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কিছু কিছু ভারতীয় শেয়ার বিক্রি করে দেবার ফলে দেশ থেকে ডলার বেরিয়ে যেতে শুরু করল। মে মাসেও সেই ধারা অপরিবর্তিত আছে। এপ্রিল-মে মিলিয়ে এখন পর্যন্ত শেয়ার বাজার থেকে বেরিয়ে গেছে প্রায় চারশো মিলিয়ন ডলার। এর অবধারিত ফল টাকার নিম্নগতি। যে ডলার ঊনপঞ্চাশ টাকায় নেমেছিল, ক্রমশ বাড়তে বাড়তে তার দাম মে মাসের ২৩ তারিখে ছাপান্ন ছাড়িয়ে গেল। এবং এর ফলে এক লাফে প্রায় আট টাকা বেড়ে গেল তেলের দাম, আর তার সঙ্গে কয়েক গুণ বেড়ে গেল সাধারণ মানুষের দুঃখকষ্ট।
অভিযোগ উঠবে, কেন্দ্রীয় সরকার এমন নীতি নিয়েছে, যার ফলে সাধারণ মানুষের ভাগ্য, বলতে গেলে সারা দেশের ভাগ্য, শেয়ার বাজারের খামখেয়ালিপনার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। আরও গুরুতর অভিযোগ, যখন শেয়ার বাজারে প্রচুর ডলার আসছিল আর টাকার দাম বাড়ছিল, তখন তো সরকার তেলের দাম কমানোর কথা এক বারও ভাবেনি। তার মানে, শেয়ার বাজারের সুদিনের ফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না, কিন্তু তাকে দুর্দিনের ধাক্কাটা সামলাতে হচ্ছে। অভিযোগগুলো করার আগে কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থান তথা জবাবদিহিগুলো খতিয়ে দেখা দরকার।
বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকারের প্রথম বক্তব্য, এই অবস্থার জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ নীতির থেকে আন্তর্জাতিক মন্দা, বিশেষত ইউরোপের অর্থনৈতিক সংকট অনেক বেশি দায়ী। অর্থাৎ বলা হচ্ছে, দেশের মধ্যে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তার ওপর সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ইউরোপের সংকট দু’ভাবে আমাদের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে। এক, সম্মিলিত ভাবে ইউরোপের বাজারে আমাদের মোট রফতানি প্রায় ২০ শতাংশ বিক্রি হয়। কাজেই ইউরোপে মন্দা চলার ফলে আমাদের রফতানি সরাসরি ভাবে কমে যাচ্ছে, কমছে বিদেশি মুদ্রার উপার্জন, ফলে টাকার মূল্যের ওপর চাপ বাড়ছে। দুই, ইউরোপে মন্দা চলার কারণে ডলারের তুলনায় ইউরো দুর্বল হচ্ছে। ফলে যে ইউরো আমরা ইউরোপ থেকে রফতানির মাধ্যমে উপার্জন করছি, ডলারে নিয়ে যাওয়ার সময় তার মূল্য কমে যাচ্ছে। সরকারের দ্বিতীয় বক্তব্য, নানা কারণে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত উল্লেখযোগ্য মুদ্রার তুলনাতেই এখন মার্কিনি ডলারের দাম বাড়ছে, কাজেই ভারতীয় টাকার অবমূল্যায়ন কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তৃতীয়ত, কোনও কোনও মহল থেকে বলা হচ্ছে, শরিকি রাজনীতির চাপে সরকার বিমা, পেনশন, খুচরো ব্যবসা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোকে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করতে পারছে না। ফলে ভারতীয় অর্থনীতিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমছে, যার কুপ্রভাব ভারতীয় শেয়ার বাজারে বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের ওপরেও পড়ছে।
|
সরকার কি ভুল বোঝাচ্ছে? |
একটু ভেবে দেখলে কিন্তু সরকারি যুক্তি নিয়ে কিছু কিছু প্রশ্ন দেখা দেবে। প্রথমত, ইউরোপের মন্দা আমাদের ২০ শতাংশ রফতানির বাজারকে প্রভাবিত করছে এটা ঠিক, কিন্তু বাকি ৮০ শতাংশ বাজারকে আমরা কাজে লাগাতে পারছি না কেন? লক্ষণীয় যে, ভারতীয় টাকা যত দুর্বল হচ্ছে, বিশ্বের বাজারে ততই কিন্তু দাম কমছে আমাদের রফতানির। আমরা সেই সুযোগ কেন কাজে লাগাতে পারছি না? বিশেষ করে আমাদের প্রতিবেশী চিন যখন কৃত্রিম ভাবে তার মুদ্রার মূল্য কমিয়ে রেখে দেশের রফতানি বিপুল ভাবে বাড়িয়ে যেতে পেরেছে। দ্বিতীয়ত, গত কয়েক মাস ধরে মার্কিনি ডলারের তুলনায় প্রায় প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটেছে এটা যেমন সত্যি, তেমনই এটাই সত্যি যে, গত মার্চ মাস থেক শুধু মার্কিনি ডলার নয়, ইয়েন, পাউন্ড, ইউরো, অস্ট্রেলিয়ান ডলার, ক্যানেডিয়ান ডলার, চিনে ইউয়ান ইত্যাদি প্রায় প্রত্যেকটি মুদ্রার তুলনায় টাকার দাম কমেছে। মানে, মার্কিনি ডলারের নিরিখে এই মুদ্রাগুলি যতটা কমজোরি হয়েছে, ভারতীয় টাকা কমজোরি হয়েছে তার থেকে বেশি। অর্থাৎ, আলাদা করে টাকার কিছু সমস্যা আছে, যা অন্যদের নেই। তৃতীয়ত, আর্থিক ক্ষেত্র-সহ কিছু কিছু ক্ষেত্রকে যে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখাটা অভিপ্রেত নয়, ২০০৮ সালের বিশ্বব্যাপী মন্দা সেটা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে বিমা কিংবা খুচরো ব্যবসায় বিদেশিদের প্রবেশ অবাধ করে দেওয়াটা কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
স্বীকার করা ভাল, কিছু গভীর অভ্যন্তরীণ সমস্যা আমাদের চলছে। ইদানীং ভারতীয় শিল্পের বৃদ্ধিহার উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গেছে। ফলে সার্বিক ভাবে বিদেশিদের কাছে ভারতীয় কোম্পানিগুলির লাভজনকতা এবং আকর্ষণ হ্রাস পেয়েছে। তাই শেয়ার বাজারে বিদেশি বিনিয়োগও কমেছে। তা ছাড়া, বেশ কিছু দিন ধরে কেন্দ্রীয় সরকার তার বাজেট ঘাটতি কমাতে পারছে না। এই ঘাটতি সামলাতে গিয়ে ভবিষ্যতে করবৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে, যে কারণে বিদেশিরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে ভারতীয় কোম্পানিদের শেয়ারগুলির দাম ও আকর্ষণ কমবে। উপরন্তু দীর্ঘমেয়াদি মূল্যস্ফীতির হার কমাতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। আমেরিকার তুলনায় ভারতীয় মূল্যস্ফীতি যদি অনেক দিন ধরে বেশি থাকে, তা হলে ডলারের তুলনায় টাকার দাম তো কমবেই।
আসল তর্কটা হল, এই মন্দার সময়ে আমাদের বাজারগুলোকে আমরা কতটা অবাধ করব, এই নিয়ে। সরকারের তরফে মনে করা হচ্ছে, বাজার আরও অবাধ হলে, অর্থনৈতিক সংস্কার আরও জোরদার হলে আরও আরও প্রাতিষ্ঠানিক বিদেশি বিনিয়োগ শেয়ার বাজারে ঢুকে সব সমস্যার সমাধান করে দেবে। এই মনে করার মধ্যে কিছুটা ইচ্ছেপূরণের মিশেল আছে। তা ছাড়া, শেয়ার বাজার দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে গেলে শেয়ার বাজারের অনিশ্চিত ওঠাপড়ার সঙ্গে সাধারণ মানুষের ভাগ্যও জড়িয়ে পড়বে। তার চেয়ে, স্বল্প মেয়াদের জন্য বিদেশি মুদ্রার বাজারে কিছু নিয়ন্ত্রণ আসা ভাল। বর্তমান ব্যবস্থায় ডলার বিক্রির ব্যাপারে সরকার অত্যন্ত দরাজ। বিদেশভ্রমণে ভারতীয়রা গত বছর তেরো-চোদ্দো বিলিয়ন ডলার খরচ করেছেন। এই অঙ্কটা কমাতে পারলে এবং কিছু কিছু অদরকারি আমদানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করলে শেয়ার বাজার থেকে পালিয়ে যাওয়া ডলারের অনেকটাই পুষিয়ে যাবে।
|
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা-য় অর্থনীতির শিক্ষক |
|
|
|
|
|