পেট্রোল-রাজনীতির তালিকায় নতুন নাম এ বার এম করুণানিধি।
তেলের দাম বাড়ার প্রতিবাদে এনডিএ-র ডাকা ভারত বন্ধের এক দিন আগে কেন্দ্রের ‘জনবিরোধী’ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হঠাৎই গর্জে উঠলেন ডিএমকে প্রধান। তবে সেই গর্জন এবং তার সঙ্গে ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন তোলার প্রচ্ছন্ন হুমকি খুবই ক্ষণস্থায়ী ছিল। তাঁর মন্তব্য নিয়ে ‘ভুল বোঝাবুঝি’র অবকাশ না দিয়ে দ্রুত নিজের অবস্থান পাল্টে অশীতিপর কালাইনার বলেন, “কেন্দ্রে শাসক জোট থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলিনি। আমার কথা ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে।” পরে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করার জন্য তিনি টি আর বালুকে প্রধানমন্ত্রীর কাছেও পাঠান।
অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য, আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত পেট্রোলের দাম বৃদ্ধি এবং টাকার অবমূল্যায়নের ফলে পেট্রোলের দাম এক লাফে অনেকটা না বাড়িয়ে উপায় ছিল না। আবার অর্থনীতির অঙ্কই বলছে, সম্প্রতি ডলারের তুলনায় টাকার দাম কিছুটা বাড়ায় এবং অশোধিত তেলের দাম অনেকটাই কমে যাওয়ায় আগামী দফায় পেট্রোলের দাম কমাতে পারে তেল সংস্থাগুলি। নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে তেল বিপণন সংস্থাগুলি খুব শীঘ্র সেই ঘোষণা করতে পারে। তবে সেটা হবে একেবারেই অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত। সম্প্রতি পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকও সেই ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে।
এই পরিস্থিতি বোঝার পরেও ইউপিএ শরিকরা রাজনীতির পথ থেকে সরেননি। আজ করুণানিধির ‘জেহাদ’ এবং তার পরে ‘ডিগবাজি’ থেকেই সেটা ফের স্পষ্ট। কালাইনার যত গর্জালেন, তার এক শতাংশও বর্ষালেন না।
কংগ্রেস নেতৃত্বও তাই বিশেষ বিচলিত নন। এর আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে পথে নেমেছিলেন। তবে একই সঙ্গে তিনি জানিয়ে দেন, কেন্দ্রে অস্থিরতা তৈরি করতে চান না বলে, সমর্থন প্রত্যাহারের কথা ভাবছে না তৃণমূল।
কংগ্রেস তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার এক বর্ষীয়ান নেতার কথায়, রাজনৈতিক চাপ সত্ত্বেও প্রতিকূল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে পিছু হটার কোনও বার্তা দিতে রাজি নয় সরকার। বরং এটাই তুলে ধরা হচ্ছে যে, পেট্রোলের দাম নির্ধারণ তেল বিপণন সংস্থাগুলি তথা বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায়ন্তর নেই।
কংগ্রেস নেতৃত্বের বক্তব্য, সরকারের এই অবস্থানের সঙ্গে দলের মতান্তর নেই। প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি বা দলের দু’এক জন নেতা প্রকাশ্যে যে মন্তব্য করেছেন, তা সামলে ঐক্যবদ্ধ মুখ তুলে ধরতে সোমবার কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত বৈঠক ডাকা হয়েছে। সব ক’জন প্রদেশ সভাপতি ও পরিষদীয় দলনেতা সেখানে উপস্থিত থাকবেন। বৈঠকে বলা হবে, বিশ্ব জুড়ে যে আর্থিক সঙ্কট চলছে তারই প্রভাব পড়ছে এ দেশে। এর জন্য কেন্দ্র দায়ী নয়। বরং এই প্রতিকূল পরিস্থিতি কাটাতে কেন্দ্রকে বাধ্য হয়েই কিছু অপ্রীতিকর সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। তাই সংকীর্ণ রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সরকারের পাশে দাঁড়ানো উচিত বিরোধীদেরও।
করুণানিধি আজ প্রথমে বলেন, “এর আগে যে সরকারে ডিএমকে ছিল (ভিপি সিংহ ও এনডিএ), তাদের জনবিরোধী নীতি মাত্রা ছাড়ালে আমরা সমর্থন তুলে নিতে দ্বিধাবোধ করিনি। আশা করব, এ বার কেন্দ্র সেই পরিস্থিতি তৈরি করবে না।”
এই নিয়ে হইচই শুরু হলে কিছু ক্ষণের মধ্যেই করুণানিধি জানান যে, সংবাদমাধ্যম তাঁর কথার ভুল ব্যাখ্যা করেছে। তিনি সমর্থন প্রত্যাহারের হুমকি দেননি। এ ব্যাপারে কংগ্রেস মুখপাত্র রশিদ আলভি বলেন, “পেট্রোলের দাম বাড়ার জন্য ডিএমকে-র উদ্বেগ স্বাভাবিক। কংগ্রেসও উদ্বেগে রয়েছে।” পরে ঘরোয়া আলোচনায় কংগ্রেস নেতারা বলেন, তামিলনাড়ুর রাজ্য রাজনীতির কারণেই কালাইনার এই মন্তব্য করেছেন। তবে ডিএমকে সমর্থন প্রত্যাহার করবে বলে কংগ্রেসও মনে করে না। কেননা সেই রাজনৈতিক শক্তি এখন তাদের নেই।
এখন প্রশ্ন হল, পেট্রোলের দাম বাড়িয়েও সরকার এ যাত্রায় হয়তো উতরে গেল ঠিকই, এর পর ডিজেল বা রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ানোর মতো ঝুঁকি কি এখনই আর নিতে চাইবে? তেল সংস্থাগুলির দাবি তো বটেই, প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা সি রঙ্গরাজনেরও বক্তব্য, ভর্তুকির বোঝা কমাতে ডিজেলের দাম অন্তত চার টাকা বাড়ানো জরুরি। সেই সঙ্গে বছরে চারটি রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার ভর্তুকি মূল্যে দিয়ে বাকিগুলি বাজার দরে বিক্রির প্রস্তাবও রয়েছে।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, এ নিয়ে আলোচনার জন্য কয়েক দিনের মধ্যেই পেট্রোলিয়াম সংক্রান্ত ক্ষমতাসীন মন্ত্রিগোষ্ঠীর বৈঠক ডাকা হতে পারে। এক বছর আগে শেষ বার এই মন্ত্রিগোষ্ঠীর বৈঠক হয়েছিল। কিন্তু তার পর থেকে তা বারবার পেছানো হয়েছে। এ বারের বৈঠকে সরকার শুধু পরিস্থিতি বিবেচনা করে ক্ষান্ত হবে, নাকি ডিজেলের দাম বাড়ানোর মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই দেখার। |