ভোজন...
কর শুধু খাই, খাই আহারে বসো জামাই
জামাই আদর
তখন এখন
অনুষ্ঠান শুরু সকাল থেকে। অফিসে ছুটি নিয়ে জামাইয়ের শ্বশুরবাড়ি যাত্রা। হাতে মিষ্টির হাঁড়ি। সুবিধে মতো যে কোনও সময়ে। সাধারণত কাজ সামলে ডিনার। অবশ্য কাল রবিবার। তাই লাঞ্চ হতেও পারে। আইপিএল ফাইনাল দেখতে দেখতে ডিনারও হতে পারে। ডিনারে হাল্কা খাবারের দিকেই পাল্লা ঝুঁকে। সোমবার অফিস আছে না!
শাশুড়ির নিজের হাতে রান্না করে খাওয়ানোটা মাস্ট। সঙ্গে লাল শালুর ফ্রিল দেওয়া হাত পাখা দিয়ে শাশুড়ির জামাইকে হাওয়া করা। এসি গাড়িতে চড়ে এফএম শুনতে শুনতে নামী রেস্তোরাঁ। ভ্যালে পার্কিং করে আগে থেকে বুক করা টেবল-এ খাওয়ানো।
আম, কাঁঠাল কোয়া, লিচু, খেজুর, জাম, জামরুলে সাজানো রেকাবি দিয়ে জামাই আদর না করলে মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি। ফ্রুট স্যালাড। সঙ্গে অল্প ক্রিম থাকলেও থাকতে পারে।
কাঁসার থালায় ধোঁয়া-ওঠা গোবিন্দভোগের চুড়ো, ওপরে টুসটুসে ঘি। ফুলকো লুচি। পাশ দিয়ে উঁকি মারছে ঝুরি আলু বা বেগুনভাজা। পর পর কাঁসার বাটিতে সোনামুগের ডাল। আলু-পটলের ডালনা। পাঁচমেশালি তরকারি। পাকা রুইয়ের কালিয়া। পার্শের ঝাল। কই মাছের হর-গৌরী। কষা মাংস। কাঁচা আমের চাটনি। আর একটা কাঁসার থালায় নানা ছাঁচের নারকেলের মিষ্টি। ফুলের ছাঁচে। গোলাপ। শিউলি। রসগোল্লা। সন্দেশ। এই সমস্ত নিয়ে কাঁসার বাসন ভারিক্কি শব্দে জামাইয়ের সামনে রাখা। কাঁসার বাসন পরিচর্যা করাটা সময়সাপেক্ষ। অনেক বাড়িতে ডিজাইনার ক্রকারি। দুধেল ফিনফিনে পোর্সেলিনের ওপর হালকা স্মার্ট ডিজাইন। তার ওপর লো ফ্যাট কন্টিনেন্টাল খাবার। গ্রিল্ড ফিশ, সঁতে করা সব্জি, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে চিলি-মটন কষা, গলদা চিংড়ির চিজ প্রিপারেশন। হাজার হোক, জামাই যে বড়ই ক্যালরি কনশাস!

দুই জামাই: প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। আবির চট্টোপাধ্যায়। লোকেশন: স্যাফ্রন, দ্য পার্ক ছবি: সোমনাথ রায়
প্রসেনজিৎ, আবিরের পোশাক: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য স্টাইলিং: সুলগ্না চৌধুরি মেক-আপ: সুভাষ বেরা
যতই হোক, শ্বশুরবাড়ি না গেলে জামাইয়ের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হওয়ার চান্স ষোলো আনা। মেয়ে-জামাই বিদেশে থাকলে মা’কে ফোন করে রেসিপি নিয়ে মেয়েই রান্না করে খাওয়ায় বরকে! তার পর স্কাইপিতে জমজমাট জামাই ষষ্ঠীর আড্ডা। এ পারে শ্বশুর-শাশুড়ি। ও পারে মেয়ে-জামাই। দক্ষিণা হিসেবে জামাইয়ের অ্যাকাউন্টে স্ট্রেট চেক ট্রান্সফার।
ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে সোচ্চারে ‘ভাল থেকো বাবা’। নিরুচ্চারে ‘আমার মেয়েটাকে ভাল রেখো।’ তারপর আমপোড়ার শরবত। এখন নাকি অনেক বাড়িতে ককটেল দিয়ে চিয়ার্স করেন শ্বশুর, শাশুড়ি, জামাই, মেয়ে সবাই মিলে। কিছু পরিবার অবশ্য আজও রক্ষণশীল।
উপহার মানে দামি ধুতি-পাঞ্জাবি। ধনী পরিবার হলে এমনকি সোনার রিস্টওয়াচ পর্যন্ত। জামাই বাবাজির যা পছন্দ। ফ্রেন্ডলি জামাই হলে এক রকম। নিজেই টিপ্স দিয়ে দেবে। একটু ভারিক্কি ক্যাটেগরির হলে মেয়েকে একটা ফোনই যথেষ্ট। সোনা-পলিশের লাইটার হতে পারে। আই প্যাড বা ট্যাবলেট পিসি হতে পারে। কুর্তা-জিন্স বা ডিজাইনার পাঞ্জাবিও হতে পারে। বা ভাল বিদেশি পারফিউম।
সন্ধেবেলা শালা-শালীদের নিয়ে ‘হারানো সুর’ বা ‘সপ্তপদী’ দেখতে যাওয়া। পাশের সিটে সব থেকে সুন্দরী শালীটি। মেয়ে-জামাই-শ্বশুর-শাশুড়ি মিলে ফুড-কোর্টে ডিনার সেরে মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখে বাড়ি ফেরা। আর শালা-শালী? নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির যুগে কেউ বা বেঙ্গালুরু। কেউ বা বস্টন।

প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়
মনে আছে বাবা যখন জামাই ছিলেন তখন অনুষ্ঠানটা ছিল একটা উৎসবের মতো। দল-বল নিয়ে প্রচুর খাওয়া-দাওয়া। মেয়েদের সঙ্গে খুনসুটি। পরে সেটা আস্তে আস্তে বদলে গেল। ফ্ল্যাট সিস্টেম, ফ্যামিলি ছোট হয়ে গেলে যা হয় আর কী! আমার বোন পল্লবীর বেলায় বা আমার বেলায়ও কিছু কিছু লোকাচার ছিল। যেমন ষষ্ঠী পুজো। বা বড় হাত পাখার হাওয়া। এখন তো সব কিছুরই একটা করে নির্দিষ্ট ‘ডে’ হয়ে গেছে। ফাদার্স ডে। মাদার্স ডে। এখন এই দিনটাই আমাদের ‘জামাই ষষ্ঠী ডে’। অর্পিতার সঙ্গে বিয়ের পর প্রথম জামাই ষষ্ঠীতে শ্বশুরবাড়ি থেকে ওঁরা আমাকে একটা হিরের আংটি দিয়েছিলেন। এক বার হোটেলেও খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন। এখন নিয়ম করে উপহার পাই। ওঁরা এখন আমার পছন্দ-অপছন্দ জানেন। ডিজাইনারের সঙ্গে কথা বলে আমার জন্যে পোশাকের অর্ডার দিয়ে দেন। কলকাতায় থাকলে এই দিনটায় আমি নিয়ম করে সাবেকি পোশাক পরি। অবশ্যই ধুতি। মিলের ধুতি-পাঞ্জাবি আমার দারুণ পছন্দের। খাবার-দাবারও আসে প্রচুর। তত্ত্ব সাজিয়ে। সব বাড়ির খাবার। ডাল। আলু পোস্ত। চিংড়ি মাছ ছাড়া সব মাছই বেশ প্রিয়। ইলিশ অবশ্য খাই না। আগে তো প্রায় ১২-১৪ পিস্ একসঙ্গে খেয়ে ফেলতাম! এখন একেবারে বাদ দিয়ে দিয়েছি। সে রকমই এক বার পান্তুয়া খেয়েছিলাম ৫২টা! এখন সেটাও বাদ।

আবির চট্টোপাধ্যায়
বিয়ের আগে থেকেই যেহেতু স্ত্রী নন্দিনীর সঙ্গে সম্পর্কটা নিপাট বন্ধুত্বের, তাই কোনও দিনও পরিবারের দিক থেকেও জামাই-ষষ্ঠী সুলভ ফর্মালিটির জায়গা হয়নি। শাশুড়ি-শ্বশুর বন্ধুর মতো। আমি যতই বলি আলাদা করে জামাই ষষ্ঠীর দরকার নেই, ওঁরা এক কথায় ‘ওটা আমাদের ব্যাপার, তোমাকে পাকামি করতে হবে না’ গোছের ধমক দিয়ে উড়িয়েই দেন। কাল সকাল থেকেই ওখানে আমার নেমন্তন্ন। ইতিমধ্যে আমি মিষ্টির পোকা জেনে, বাড়িতে তত্ত্ব করে সেরা মিষ্টি ওঁরা পাঠিয়ে দিয়েছেন। তার সঙ্গে পাঞ্জাবি। পারফিউম। এখন তো একটু সাবধানে খাওয়া-দাওয়া করতে হয়। সেই নিয়েও শাশুড়ি দুঃখ করছিলেন। বলে রেখেছেন ওই এক দিন ডায়েট না করলেও চলবে। খাওয়ার ব্যাপারে আমার খুব সোজা হিসেব। বাঙালি খাবার খেতে হলে এক গাদা টাকা খরচ করে বাইরে খাব না। আর জামাই ষষ্ঠীতে ঘরোয়া বাঙালি ডিশ ছাড়া জমে না কি? আমাদের বাড়িতে আমার শাশুড়ির হাতের মাছের চপ দারুণ ফেভারিট। আমি খাব তো বটেই, বাড়ির জন্যেও ছাঁদা বেঁধে নিয়ে আসতে হবে।

যিশু সেনগুপ্ত
এক বারই জামাই ষষ্ঠী হয়েছিল। কাকিমা, মানে শাশুড়ি মুম্বই থাকেন। গত বছর উনি কলকাতায় ছিলেন। ইলিশ মাছ দারুণ প্রিয়। মনে আছে, জমিয়ে সেটা খেয়েছিলাম। একটা দারুণ শার্টও পেয়েছিলাম। আমি এমনিতেই বউকে ভয় পাই। বাকি ৯০ শতাংশ বাঙালির মতোই। সারাক্ষণই নিজেকে পিওনের মতো লাগে! কিন্তু জামাই ষষ্ঠী এমন একটা দিন যখন নিজেকে রাজা মনে হয়। সবাই খাতির করছে। খাওয়াচ্ছে। গিফ্ট দিচ্ছে। ব্যাপারটাই সাংঘাতিক।

রূপম ইসলাম
আমি শ্বশুরবাড়ির পাড়াতেই থাকি। এক বারও জামাই ষষ্ঠী মিস করিনি। আমার কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই যাওয়ার। আমার জামাই ষষ্ঠী একেবারে ইনফর্মাল। আমার শাশুড়ি আগে-ভাগেই আমাকে জিজ্ঞেস করে নেন কী খাব। আমি ওঁর রান্নার দারুণ ফ্যান। এ বার যেমন বলেই দিয়েছি লুচি-কষা মাংস খাব। স্পেশাল ড্রেস কোড-এ বিশ্বাস করি না। এখন যা গরম, তাতে যত হালকা পরা যায়, ততই স্বস্তি। হয়তো থ্রি-কোয়াটার্স পরেই কাল শ্বশুরবাড়ি চলে যাব। বা জিন্স। সঙ্গে টি-শার্ট। গিফ্ট-এর ব্যাপার-স্যাপার আমার বউয়ের ডিপার্টমেন্ট।

অনীক দত্ত
আমি কোনও দিন বিয়েই করতে চাইনি। আমার বান্ধবীকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছিলাম। লোকজন বলেছিল বিয়ে করে তার পর যাও। তাই, ঠেলায় পড়ে বিয়েটা করেছিলাম। সে অর্থে জামাই ষষ্ঠীতে বিশ্বাস করি না। তা হলে তো বউ ষষ্ঠীও হওয়া উচিত। ওই কারুকার্য-মণ্ডিত পাঞ্জাবি পরতে আমি কিছুতেই রাজি নই। নিজেকে ভীষণ বোকা-বোকা লাগে। খেতে খুবই ভালবাসি। রোজই গলদা চিংড়ি, কষা মাংস সাঁটাতে পারি। কিন্তু তার জন্যে জামাই ষষ্ঠী লাগবে কেন?

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
বিয়ের পর এক বারই আমার জামাই ষষ্ঠী হয়েছিল। আমি তখন কলকাতায় মাস্টারি করি। শ্বশুরবাড়ি ছিল কুচবিহার। পরে আর সেই অনুষ্ঠান হয়নি। কারণ সেই পরিবার ভেঙে যায়। যে বার হয়েছিল সে বারের কথা মনে আছে। আমার তখন পকেটে ছুঁচোয় ডন মারছে। গ্যাস্ট্রিকের সমস্যাও ছিল। মাছের নানা রকম পদ হয়েছিল। কিন্তু আমি সেই সুযোগের দারুণ সদ্ব্যবহার করতে পেরেছিলাম, এমন দাবি করতে পারি না। আমার মতো রোগা জামাইকে খাইয়ে শ্বশুর-শাশুড়িরও কোনও সুখ হয়নি।

ক্যালরি কাউন্ট

তখন এখন
ঘিয়ে ভাজা লুচি নান/সেঁকা কুলচা
ঘি ভাত অরগ্যানিক/রেড রাইস
ঘন মালাইদার
বাদামের শরবত
চিল্ড ডাব মোহিতো
মাছের কালিয়া গ্রিলড্ ফিশ
তেল জবজবে মটন কষা মটন রোস্ট
গলদা চিংড়ির মালাইকারি বেক্ড প্রন টোস্ট
মোটা সর দেওয়া মিষ্টি দই/রাবড়ি, আম সুগারলেস লো ফ্যাট সন্দেশ। চকোলেট


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.