সম্প্রতি দুই দেশের দুই প্রবীণ রাজনীতিক তথা প্রশাসক বাংলাদেশ সফর করিয়াছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিন্টন এবং ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন মাপকাঠিতে বাংলাদেশ যাহা অর্জন করিয়াছে, তাহার প্রশংসা অধুনা সকলেই করিয়া থাকেন, এই দুই অতিথিও করিয়াছেন। কিন্তু ঢাকা সফরের সময় তাঁহাদের কথায় একটি প্রসঙ্গ উচ্চারিত হইয়াছে, যাহা বাংলাদেশের পক্ষে শ্লাঘার নয়, চিন্তার। উভয়েই বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক নেত্রীকে একটি উপদেশ দিয়াছেন। পরস্পর কথা বলিবার উপদেশ। সেই দেশের দুইটি প্রধান দল আওয়ামী নিগ এবং বি এন পি’র দুই নেত্রী যথাক্রমে হাসিনা ওয়াজেদ এবং খালেদা জিয়া। বর্তমানে হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর আসনে, খালেদা বিরোধী নেত্রী। অতীতে দুই জনের আসন বিপরীত ছিল, হয়তো ভবিষ্যতেও থাকিবে। কিন্তু একটি বিষয়ে ধারাবাহিকতা অক্ষত, অক্ষুণ্ণ। দুই প্রধান নেত্রীর পারস্পরিক আলাপ আলোচনা হয় না, কার্যত বাক্যালাপ হয় না। প্রণববাবু এবং হিলারি ক্লিন্টন এই রীতির অবসান ঘটাইবার পরামর্শ দিয়াছেন।
কেবল সুপরামর্শ নয়, এই পরামর্শ অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের দুই নেত্রী এই পরামর্শের মূল্য অনুধাবন করিয়া আত্মসংশোধনের চেষ্টা করিলে ভাল করিবেন। তাঁহারা একটি উন্নয়নশীল দেশের দুই প্রধান নেত্রী। অনেক সমস্যা এবং বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়া দেশটি গণতন্ত্রের সাধনা করিতেছে। সেই সাধনা বহু অশান্তি এবং বিপদে কণ্টকিত, বারংবার বিপর্যস্তও হইয়াছে। উপমহাদেশের তথা তৃতীয় বিশ্বের অন্য অনেক দেশের মতোই বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহু গোষ্ঠী, বহু স্বার্থ, বহু মতের প্রাবল্য। বিরোধ প্রবল এবং কার্যত সর্বগ্রাসী। এই সকল সমস্যা এক দিনে অন্তর্হিত হইবে না। পশ্চিম দুনিয়ার পরিণত, সুস্থিত গণতন্ত্রগুলিও রাতারাতি পরিণত এবং সুস্থিত হয় নাই। এ কথাও ধরিয়া লওয়া চলে যে, বাংলাদেশের মতো দেশে বহু বিরোধ এবং অশান্তি দীর্ঘস্থায়ী হইবে। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য এইখানে যে তাহা বিরোধ এবং অশান্তিকে অস্বীকার করে না, দমনও করে না, বরং তাহাকেই স্বাভাবিক বলিয়া গণ্য করে এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের আলোচনা ও বিতর্কের পথে তাহা নিরসনের চেষ্টা করে।
এই কারণেই একটি গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরের নেতা ও নেত্রীদের পারস্পরিক মতের আদানপ্রদান অত্যন্ত জরুরি। উহাই গণতান্ত্রিকতার এক অপরিহার্য অঙ্গ। অথচ রাজনীতির নায়কনায়িকারা অনেক সময়েই সে কথা ভুলিয়া যান, তাঁহাদের নিকট দলগত, গোষ্ঠীগত বা ব্যক্তিগত বৈরের ভাবটি প্রবল হইয়া ওঠে, দেশের বা সমাজের স্বার্থ তাহার আড়ালে চলিয়া যায়। শেখ হাসিনা এবং বেগম খালেদার বিরোধেও ব্যক্তিগত বৈরের দাপট প্রকট। বাংলাদেশের রাজনীতিতে, যেমন অনেক ক্ষেত্রেই ভারতের রাজনীতিতেও, দল নেতা বা নেত্রীর অনুগামী মাত্র, নায়কনায়িকারা যেমন আচরণ করেন, দলও তথা এব চ। বাংলাদেশের দুই নেত্রীর পারস্পরিক অসহিষ্ণুতা ও বিতৃষ্ণা তাঁহাদের দলীয় অনুগামীদের মানসিকতাতেও প্রতিফলিত হয়। ইহাতে ক্ষতি হয় দেশের এবং সমাজের। ভিন্ন দেশের রাজনীতিকদের সদুপদেশ তাঁহাদের সংবিৎ ফিরাইতে পারিবে কি? সংবিৎ এবং সহবৎ? |