কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী তাঁহার দলীয় সাংসদদের মনোবল চাঙ্গা করিতে সম্প্রতি এক বৈঠক ডাকিয়াছিলেন। কংগ্রেস সংসদীয় দলের সেই বৈঠক সংসদের ভিতরে-বাহিরে অকংগ্রেসি নেতাদের বিভিন্ন অভিযোগের মোকাবিলার জন্য তিনি ইউ পি এ সরকারের কীর্তি হিসাবে যাহা বিবৃত করিয়াছেন এবং যে ভাষা ও ভঙ্গিতে তাহা করিয়াছেন, তাহাতে কিছু সংশয় সৃষ্টি হইয়াছে। যেমন সনিয়ার দাবি, গত আট বছরে তাঁহার সরকার রাজ্যগুলিকে ‘অভূতপূর্ব হারে আর্থিক সহায়তা দান’ করিয়াছে। এবং এই সহায়তাই নাকি ইউ পি এ-র তরফে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা শক্তিশালী করার অব্যর্থ প্রমাণ। কংগ্রেস নেত্রীর ভাবখানা এমন, যেন ওই ‘সহায়তা’ রাজ্যগুলির প্রাপ্য ছিল না, নিছক মহানুভবতা হইতে ইউ পি এ সরকার তাহা বিতরণ করিয়াছে। ইহা কংগ্রেস দলের সেই চিরাচরিত মানসিকতা, যাহা যুক্তরাষ্ট্রীয় বিকেন্দ্রীকরণের সাংবিধানিক নীতিকে পদে পদে অন্তর্ঘাত করিয়া একটি কেন্দ্রাভিগ শাসনব্যবস্থা গড়িয়া তুলিতে চাহিয়াছে। সনিয়া গাঁধী এ ক্ষেত্রে সেই কংগ্রেসি ঐতিহ্য তথা রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই উত্তরাধিকার বহন করিয়া চলিয়াছেন।
বাবাসাহেব অম্বেডকর যে যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতিকে সাংবিধানিক মর্যাদা দিতে চাহিয়াছিলেন, নেহরুর ‘শক্তিশালী কেন্দ্র’ ও এককেন্দ্রিক, নিদেনপক্ষে কেন্দ্রাভিগ বন্দোবস্তের অনুশীলন নিয়মিত সেই যুক্তরাষ্ট্রীয়তাকে খর্ব করিয়াছে। কেবল কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন শাসক দলই নয়, রাজ্যে-রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের সরকারও মনে করিয়াছে, কেন্দ্রের কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাতা কিংবা বাড়তি আর্থিক সুবিধা বা করের অংশীদারি লইয়া দর কষাকষির বাহিরে তাহাদের করণীয় কিছু নাই। যুক্তরাষ্ট্রীয়তা যে কেবল বাড়তি আর্থিক বিকেন্দ্রীকরণ নয়, একই সঙ্গে অতিরিক্ত রাজনৈতিক ক্ষমতার দাবি তথা কেন্দ্র-রাজ্য ক্ষমতার পুনর্বিন্যাসের আন্দোলনও, এ কথা প্রায়শ বৈধ জনাদেশে নির্বাচিত রাজ্য সরকারগুলিরও খেয়াল হয় না। কেন্দ্রীয় শাসক দল, বিশেষত কংগ্রেস তাহার পূর্ণ সুযোগ লইয়া অর্থ ও ক্ষমতার পুনর্বিন্যাসকে তাহার ‘দয়ার দান’ রূপে প্রচার করিয়াছে। সম্প্রতি যে-সব প্রশ্নে ইউ পি এ সরকারের বিরুদ্ধে রাজ্যে-রাজ্যে বিরোধী দলগুলির সরকার, এমনকী ইউ পি এ-র শরিক দল তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারও মুখর, তাহার মধ্যে যেমন রাজ্যের আর্থিক অংশীদারির দাবি রহিয়াছে, তেমনই আছে রাজ্যের রাজনৈতিক এক্তিয়ারে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের প্রতিবাদও। কেন্দ্রীয় লোকপাল বিলের অধীনে রাজ্যে-রাজ্যে লোকায়ুক্ত নিয়োগের একতরফা বিধান, সন্ত্রাস দমন অভিযানের জন্য রাজ্যে-রাজ্যে কেন্দ্রীয় দমন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপনের একতরফা সিদ্ধান্ত কংগ্রেস নেতৃত্বকে গিলিয়া ফেলিতে হইয়াছে। রাজ্যগুলির সহিত পরামর্শ না করিয়া রাজ্যের ঘাড়ে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত চাপাইয়া দেওয়াই ভ্রান্ত নীতি, যাহার নিন্দায় বিরোধীরা, এমনকী শরিক দলগুলিও সরব।
কিন্তু সনিয়া গাঁধী তথা কংগ্রেস নেতৃত্ব যে ভাবে বিষয়গুলি বিচার করিতেছেন, তাহাতে এই বাস্তবতার স্বীকৃতি নাই। যেন যুক্তরাষ্ট্রীয় ক্ষমতাবিন্যাসের দাবি করা ভুল এবং সংসদের ভিতরে-বাহিরে সেই ভুলের জবাব দিবার জন্যই সনিয়ার পাঠশালা। অথচ বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি হইতে প্রেরিত অন্তত কুড়িটি বিল রাজ্যপাল বা রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের অপেক্ষায় বছরের পর বছর আটকাইয়া আছে। সন্ত্রাস দমন প্রশ্নে অটলবিহারী বাজপেয়ীর এন ডি এ সরকারের সহিত পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের যে বোঝাপড়া ছিল, আপন শরিক তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারের সহিত ইউ পি এ সরকারের তাহা নাই। রাজ্য সরকারকে অন্ধকারে রাখিয়া যে ভাবে তিস্তার জলের ভাগ লইয়া প্রতিবেশীর সহিত ইউ পি এ সরকার চুক্তিতে উদ্যত হয়, তাহাও যুক্তরাষ্ট্রীয় আদর্শ ও কর্মনীতির অনুসারী নয়। সনিয়া গাঁধী এবং তাঁহার দলকে বুঝিতে হইবে, যুক্তরাষ্ট্রীয়তা আদর্শের প্রশ্ন, টাকার বণ্টনের প্রশ্ন নয়। |