ঘটনার এক দিন পরে টিভি-ক্যামেরার সামনেই আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে তর্জনী উঁচিয়ে তিনি বলেছিলেন, “আমি ওঁকে (শিক্ষিকাকে) বলি, আপনি কে? গলা নামিয়ে কথা বলুন! কে আপনাকে আঙুল উঁচিয়ে কথা বলার অধিকার দিয়েছে?”
এর চার দিন পরে, সোমবার চিত্র-সাংবাদিকদের ক্যামেরা থেকে নিজেকে আড়াল করে চুপিচুপি কখন যে তিনি এজলাসে ঢুকে গেলেন, কেউ টেরও পেল না!
সে দিন সানগ্লাস, নীল-সাদা টি শার্ট, আকাশনীল জিন্স, স্নিকার পরে তিনি বলেছিলেন, “লিউকোপ্লাস্ট খুলে দেখা হোক, ওঁর আদৌ আঘাত লেগেছে কি না!”
এ দিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে শুধু বললেন, “নো কমেন্টস।” |
মাত্র এ ক’দিনেই সেই ‘তর্জন-গর্জন’ উবে গিয়েছে ভাঙড়ের প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক তথা ভাঙড় কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি আরাবুল ইসলামের। গত ২৪ এপ্রিল, মঙ্গলবার ভাঙড় কলেজের স্টাফরুমে তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা শিক্ষিকা দেবযানী দে’কে কটূক্তি করেন এবং জগ ছুড়ে মারেন বলে অভিযোগ। সোমবার দুপুরে তিনিই কার্যত ‘মুখে কুলুপ’ এঁটে আদালত চত্বর ছাড়লেন। ‘আক্রান্ত’ হওয়ার পাঁচ দিন পরে রাজ্যপালের আশ্বাসে ‘ভয় কাটিয়ে’ দেবযানী-সহ ৯ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা দক্ষিণ ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গ্রামীণ)-এর কাছে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন আরাবুল ও তাঁর ছেলে হাকিবুল ইসলামের (ভাঙড় কলেজে ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক) বিরুদ্ধে। ঘটনার পরে প্রবল জনমতের চাপে পড়ে আরাবুলের বিরুদ্ধে তদন্তে নামে পুলিশ। দলের নেতারাও উচ্চতর নেতৃত্বকে জানিয়ে দেন, আমজনতা আরাবুলের আচরণকে ভাল চোখে দেখছে না। স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের একাংশও জানিয়েছেন, ২০০৬-এ কলেজের ভোটে কারচুপি ঠেকাতে দেবযানী ও আরও কয়েক জন শিক্ষিকা রাতে ব্যালট বাক্স পাহারা দিয়েছিলেন। সেই ভোটে তৃণমূল সমর্থিত ছাত্রগোষ্ঠীই জয়লাভ করেছিল। অথচ ওই শিক্ষিকাকেই এখন ‘কাঠ সিপিএম’ বলে দেগে দেওয়ার চেষ্টা চলছে!
এবং তৃণমূল সূত্রের ইঙ্গিত, সাধারণ মানুষ ও দলীয় নেতাদের একাংশের ক্ষোভ আঁচ করেই দল আর এখন আরাবুলের পাশে আগের মতো করে ‘দাঁড়াচ্ছে’ না। এ দিন তৃণমূলের মহাসচিব তথা রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও বলেন, “দলের মনোভাবের কথা আরাবুলকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।” মনোভাবটা কী?
পার্থবাবু বলেন, “ইতিমধ্যে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, শিক্ষাক্ষেত্রে কোনও অবস্থাতেই কোনও পক্ষে বিশৃঙ্খলা বরদাস্ত করা হয়নি, হবেও না। শিক্ষাক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতির সঙ্কীর্ণতা ভুলে রাজনীতিমুক্ত পঠনপাঠন পরিষেবা চালু রাখতে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ।”
তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য, দলের এই মনোভাবের প্রতিফলনই পড়েছে এ দিন আরাবুলের আচরণে। পাশাপাশি আরাবুলের বিরুদ্ধে পুলিশি তদন্ত এ দিন শুরু হয়েছে একেবারে ‘নিয়ম’ মেনে। এ দিন ভাঙড় কলেজে অভিযোগকারী ৯ শিক্ষক-শিক্ষিকার জবানবন্দি ‘ভিডিও রেকর্ড’ করেছে পুলিশ। ঘটনার দিন কলেজে হাজির থাকা অশিক্ষক কর্মীদের বয়ানও নেওয়া হয়েছে। জেলা পুলিশের এক কর্তার কথায়, “নিয়ম থাকলেও অনেক সময়ে জবানবন্দি রেকর্ড করা সম্ভব হয় না। কিন্তু এটি বিশেষ ঘটনা। তাই কোনও ঝুঁকি নিতে চাই না।”
এ হেন ‘প্রবল চাপের’ মধ্যেই এ দিন দুপুরে বারুইপুর মহকুমা আদালতে আত্মসমর্পণের জন্য হাজির হন অভিযুক্ত বাবা-ছেলে। অন্যান্য দিনের তুলনায় এ দিন ওখানে পুলিশি প্রহরাও ছিল বেশি। দুপুর পৌনে দু’টো নাগাদ কালো গাড়িটা ভিড়ে ঠাসা আদালত চত্বরে ঢুকতেই ছুটে গিয়েছিলেন চিত্র-সাংবাদিকেরা। আরাবুলের নামার কথা ছিল ওই গাড়ি থেকে। কিন্তু গাড়ির দরজা খুলে হলুদ-সাদা কুর্তা গায়ে যিনি নামলেন, তিনি হাকিবুল! আরাবুল কোথায়?
জানা গেল, পায়ে হেঁটে আরাবুল ততক্ষণে এজলাসে পৌঁছে গিয়েছেন। সংবাদমাধ্যমের নাগাল থেকে যতটা সম্ভব দূরে রেখে হাকিবুলকেও নিয়ে যাওয়া হল এজলাসে। পুলিশ সূত্রে খবর: আদালত চত্বরে ঢোকার আগে লাগোয়া বটতলায় কালো গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছিলেন আরাবুল।
মিনিট বিশেক বাদে আইনজীবী হাফিজুর রহমানকে নিয়ে আরাবুল আদালতের বাইরে আসেন। পরনে হাল্কা নীল ও ফিকে বেগুনি স্ট্রাইপ্ড হাফস্লিভ শার্ট, নীল জিন্স। বেরোলেন হাকিবুলও। সঙ্গে আরও জনা পনেরো লোক। হাবেভাবে আগের ‘দাপট’ উধাও। প্রশ্ন শুরু করতেই প্রাক্তন বিধায়ক শুধু দু’টো শব্দ উচ্চারণ করলেন। “নো কমেন্টস।” ততক্ষণে বাবা-ছেলেকে ঘিরে বাড়তি নিরাপত্তার বেষ্টনী তৈরি হয়ে গিয়েছে। হাফিজুর অবশ্য বলেন, “আমার মক্কেলের বিরুদ্ধে অপমানজনক মন্তব্য ও কুৎসা করা হয়েছে। উনি একটি কলেজের সভাপতি। তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ আনা হয়েছে। আমি আদালতকে সব জানিয়েছি।” বিচারক এ দিন অভিযুক্তদের প্রত্যেককে এক হাজার টাকার বন্ডে জামিনে মুক্তি দিয়েছেন।
এ দিকে এ দিন দুপুরে ভাঙড় কলেজের অভিযোগকারী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং অশিক্ষক কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে পুলিশ। ভাঙড় থানার ওসি আশিস দাস কলেজের অধ্যক্ষ ননীগোপাল বারিকের থেকে ঘটনার দিনের হাজিরা-তালিকা নেন। ওই তালিকার ভিত্তিতেই এ দিন মোট ১৫ জনের বয়ান রেকর্ড করা হয় বলে পুলিশ-সূত্রের খবর।
ভাঙড় কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকারা শনিবারই কলেজে বসে পুলিশের কাছে একপ্রস্ত বয়ান দিয়েছিলেন। এ দিন কলেজে গিয়ে তাঁরা জানতে পারেন, আবার তাঁদের বয়ান দিতে হবে, এবং তার অডিও-ভিডিও রেকর্ডিং করা হবে। সেই মতো বেলা একটা থেকে ভাঙড় থানার পুলিশ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বয়ান নিতে শুরু করে। প্রক্রিয়াটি চলে প্রায় রাত আটটা পর্যন্ত। তার আগেই অবশ্য অধ্যক্ষ কলেজ ছেড়ে চলে যান। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে মূলত জানতে চাওয়া হয়, ২৪ এপ্রিল ঠিক কী ঘটেছিল। কলেজের ভূগোলের শিক্ষিকা দেবযানী দে’কে জলের জগ ছুড়ে মারা হয়েছিল কি না। হয়ে থাকলে কে মেরেছিলেন। পুলিশ সূত্রের খবর: পুলিশের কাছে দায়ের অভিযোগে জগ ছোড়ার প্রসঙ্গ না-লিখলেও এ দিনের বয়ানে একাধিক শিক্ষক-শিক্ষিকা প্রসঙ্গটির উল্লেখ করেছেন। কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি তথা প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক আরাবুল ইসলাম ঘটনায় জড়িত বলেও দাবি করা হয়েছে পুলিশের কাছে। বয়ান দিয়েছেন স্বয়ং দেবযানীও। কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনেকেরই বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তাঁর প্রশাসনের উপরে আমাদের আস্থা রয়েছে। কিন্তু ওই ঘটনার পরে কলেজে যেন দমবন্ধ পরিবেশ তৈরি হয়েছে। উপরন্তু কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি এ দিন জামিন পেয়েছেন। আমরা কলেজে আসতে-যেতে ভয় পাচ্ছি।” কলেজে শান্তি ফিরুক, এটাই ওঁদের কাম্য বলে জানিয়েছেন ওই শিক্ষক-শিক্ষিকারা। |