অধুনা পশ্চিমবঙ্গে সর্বাধিক ব্যবহৃত শব্দটি নিঃসন্দেহে ‘পরিবর্তন’। শব্দটির একটি স্থানীয় অর্থ তৈরি হইয়াছে: চৌত্রিশ বৎসরের বাম শাসনের অবসান ঘটাইয়া তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার গঠন। ইহা ক্ষুদ্র অর্থ। বৃহৎ অর্থে ভাবিলে, বাম জমানায় রাজধর্ম পালনে শাসকগোষ্ঠী যে ভাবে ব্যর্থ হইয়াছিল, সেই ব্যর্থতা হইতে উত্তরণই সম্যক ‘পরিবর্তন’ রূপে বিবেচিত হইবার যোগ্য। পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্য, এই রাজ্যে ক্ষুদ্র অর্থে পরিবর্তন সাধিত হইয়াছে বটে, বৃহৎ পরিবর্তনটি অধরাই থাকিয়া গিয়াছে। অন্তত, বহুলাংশে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হইলেন, প্রত্যাশিত ছিল, তিনি রাজধর্ম বা রানিধর্ম পালনের পথে হাঁটিবেন। তাঁহার শাসনের প্রথম এগারো মাস সেই প্রত্যাশা যথেষ্ট পূরণ করিতে পারে নাই। যে কোনও নূতন সরকারের পক্ষেই প্রথম এক বৎসর অতি গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল, প্রচলিত ব্যবস্থাকে বড় ধাক্কা দিতে হইলে প্রথম বৎসরটিই সেরা সময়। শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এই সময়টি নষ্ট করিয়াছে। বৎসর যখন প্রায় শেষ, তখন প্রথম বার বোধ হইল, হয়তো তিনি রাজধর্মের দাবি পূরণ করিবার কথা ভাবিতেছেন। অন্তত তাঁহার সাম্প্রতিক আচরণে তাহার কিছু ইঙ্গিত মিলিয়াছে। ভাঙড় কলেজ-কাণ্ডে অভিযুক্ত আরাবুল ইসলামের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হইয়াছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্রের নিগ্রহকারীদের গ্রেফতার করা হইয়াছে। দলের ছাত্র সংগঠনের প্রগল্ভ নেতা শঙ্কুদেব পণ্ডাকে ডাকিয়া মুখ্যমন্ত্রী বাক্সংযমের পরামর্শ দিয়াছেন। এই সিদ্ধান্তগুলি ইঙ্গিত করিতেছে, হয়তো শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় প্রশাসনকে দলের ঊর্ধ্বে স্থান দিবার কথা বিবেচনা করিতেছেন। ইহাই রাজধর্মের মূল কথা। শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, কোনও একটি বিশেষ দলের নহেন। তিনি রাজ্যের স্বার্থ দেখিবেন, দলের নহে। ইহাই রাজধর্ম। এই ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হওয়াই পরিবর্তন।
রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা যেমন প্রশাসকের কর্তব্য, উন্নয়নের পরিবেশ সৃষ্টি করাও একই রকম জরুরি। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রশ্নে শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের অহেতুক জেদ সেই পরিবেশ নষ্ট করিতেছিল। সম্ভবত তিনি ভাবিতেছিলেন, নির্বাচনের পূর্বে তাঁহার দলীয় ইশতেহার যে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল, তিনি তাঁহার অন্যথা করিবেন কী উপায়ে? মুখ্যমন্ত্রী যে নিজের জেদ সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করিয়াছেন, তেমন সংবাদ এখনও পাওয়া যায় নাই। কিন্তু তাঁহার সুর ক্রমে বদলাইতেছে। হয়তো তিনি উপলব্ধি করিতেছেন যে, ইশতেহারের প্রতিশ্রুতিভঙ্গ করিলে মা-মাটি-মানুষের প্রতি যতখানি অবিচার করা হয়, জেদের বশে রাজ্যের শিল্প-সম্ভাবনাকে সমূল উচ্ছেদ করিলে অবিচার তাহার বহু গুণ বেশি। এই উপলব্ধিতে রাজধর্ম পালনের পথে অগ্রসর হওয়ার ইঙ্গিত রহিয়াছে। যেমন বি কে বিড়লা ও তাঁহার পরিবারের সহিত সময় কাটানোর সিদ্ধান্তটিও ইঙ্গিতবাহী। সরকারের একাধিক আচরণে ও উক্তিতে এই শহরের অবাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি ভীতির সঞ্চার করিয়াছিল তাঁহারা আশঙ্কা করিতেছিলেন, এই সরকার হয়তো তাঁহাদের প্রতি বিদ্বিষ্ট। রাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থে এই আশঙ্কাটি দূর করা অতি জরুরি ছিল। মুখ্যমন্ত্রী সেই প্রয়োজন অনুভব করিয়াছেন বলিয়াই আশা।
তবে কি পশ্চিমবঙ্গে সেই বহুকাঙ্ক্ষিত ‘বৃহৎ পরিবর্তন’ আসিল? এখনও তেমন কথা বলিবার সময় আসে নাই। তবে, ইঙ্গিতগুলি ইতিবাচক। আশা করা চলে, মুখ্যমন্ত্রী অতীতের ভুল হইতে শিক্ষা লইতেছেন। গত কয়েক দিনে তিনি যাহা করিয়াছেন, সবই সেই ভুল সংশোধনের অঙ্গ। অনেক ‘ঠিক কাজ’ এখনও বকেয়া পড়িয়া আছে। স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া সেই কাজগুলি করিতে হইবে। পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটি সুশাসিত হইবে কি না, এই প্রশ্নের উত্তর শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁহার সরকারের উপর নির্ভর করিতেছে। শুধু মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে ‘পরিবর্তন’ আসিলেই চলিবে না, মন্ত্রীদের মনেও ইতির অনুপ্রবেশ প্রয়োজন। সুব্রত মুখোপাধ্যায়, হয়তো আরাবুল ইসলামকে সমর্থন করিবার বাসনায় বেসামাল হইয়া, খাস মহাকরণে দাঁড়াইয়া ভাঙড় কলেজের শিক্ষিকার ব্যক্তিগত জীবন লইয়া চর্চায় মাতিয়াছিলেন। অতি নিন্দনীয় আচরণ। মন্ত্রীদের সংযত হইতে বলাও মুখ্যমন্ত্রীর কর্তব্য। তিনি রাজধর্মের উদ্দেশে যাত্রা আরম্ভ করিয়াছেন বলিয়াই আশা। সম্পূর্ণ প্রশাসনকে তিনি সফরসঙ্গী করুন। তাঁহার যাত্রা শুভ হউক। |